হাসিনার নির্দেশে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে আন্দোলনকারীদের হত্যার ঘটনা প্রমাণ হয়েছে: চিফ প্রসিকিউটর

ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও লেথাল উইপন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পেরেছে বলে দাবি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেছেন, তিন ব্যক্তির সঙ্গে শেখ হাসিনার কথপোকথনে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আজ বুধবার (১৫ অক্টোবার) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চতুর্থ দিনের যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন তাজুল ইসলাম। পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে এদিন দুটির যুক্তিতর্ক শেষ হয়। আগামীকাল বৃহস্পতিবারেও প্রসিকিউশন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, 'তিনি (শেখ হাসিনা) ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাসানুল হক ইনুকে (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের সভাপতি) তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে নারায়ণগঞ্জে হেলিকপ্টার থেকে ছত্রীসেনা নামানো হবে, ওপর থেকে বম্বিং করা হবে, প্যারাট্রুপার নামানো হবে।'
শেখ হাসিনা, সাবেক স্বররাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সাংবাদিকদের সামনে এসব কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালে হাসিনার সঙ্গে হাসানুল হক ইনু, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম মাকসুদ কামালের কথপোকথনের অডিও আদালতে শোনানো হয়।
তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'এসব কথোপকথনের মধ্য দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে অর্থাৎ দেশব্যাপী 'ওয়াইডস্প্রেড' এবং 'সিস্টেমেটিক' যে হামলার কথা আমরা বলছি, সেটার জন্য তার (শেখ হাসিনা) সরাসরি নির্দেশ প্রমাণিত হয়েছে।'
কথোপকথনের অডিও রেকর্ডের ওই কণ্ঠ যে শেখ হাসিনার, ট্রাইব্যুনালে তা স্পষ্ট করা হয়েছে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, 'পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছি, সিআইডি ফরেনসিক পরীক্ষা করে বলেছে, এই কণ্ঠস্বর শেখ হাসিনার। শেখ ফজলে নূর তাপস, হাসানুল হক ইনু ও এস এম মাকসুদ কামালের কণ্ঠ তারা নিশ্চিত করেছে।'
তিনি আরও বলেন, বিবিসি তাদের একটা আলাদা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই কণ্ঠস্বর এআই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। তারা নিশ্চিত করেছে এটা শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর, এআই দিয়ে বানানো নয়।
হত্যার নির্দেশনা প্রসঙ্গে প্রধান কৌঁসুলি আরও বলেন, নির্দেশটা যে সত্যিকার অর্থে শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন, তা পুলিশ বাহিনীর তদনীন্তন প্রধান সরাসরি আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন।
সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, যে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে, সেসবের নির্দেশনা তাকে দেওয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন করে তাকে এ নির্দেশনার কথা জানিয়েছিলেন। তারপর তিনি নির্দেশনাটি তার অধস্তন কর্মকর্তাদের জানান।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, এই নির্দেশনা অধস্তন কর্মকর্তাদের অর্থাৎ ঢাকা মহানগর পুলিশের তদানীন্তন কমিশনার হাবিবুর রহমান, প্রলয় কুমার জোয়ারদার (পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক) কমান্ড সেক্টরের মাধ্যমে, ওয়্যারলেস মেসেজের মাধ্যমে বিভিন্ন কমান্ড পোস্ট, বিভিন্ন জায়গায় যেসব বাহিনীকে নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের কাছে পৌঁছে দেন।
তিনি এ বিষয়ে আরও বলেন, 'এই যে চেইন, হুকুম দেওয়া থেকে শুরু করে মাঠপর্যায় পর্যন্ত কার্যকর হওয়া এবং সেটার পরিণামে কীভাবে মানুষগুলো মারা গেল, তাদের দেহ থেকে কীভাবে বুলেট উদ্ধার হলো, এ বুলেটগুলো কোন গ্রেডের, কোন রাইফেল থেকে বেরিয়েছে, কাদের কাছ থেকে এসেছে, এই সবকিছুর অকাট্য প্রমাণ ট্রাইব্যুনালে আমরা তুলে ধরেছি।'
তাজুল ইসলাম এ বিষয়ে আরও বলেন, 'পত্রিকার রিপোর্ট দেখিয়েছি, ভিডিও ফুটেজ দেখিয়েছি- কীভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, কীভাবে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে।'
শেখ হাসিনার এই নির্দেশ সুনির্দিষ্টভাবে ওপর থেকে ক্রমান্বয়ে নিচে এসেছে এবং তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে দাবি করে তাজুল ইসলাম বলেন, 'এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে এ অপরাধগুলো ছিল 'ওয়াইডস্প্রেড' এবং 'সিস্টেমেটিক'। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, দেশীয় আইন অনুযায়ী, একটা অপরাধকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হওয়ার জন্য ওয়াইস্প্রেড এবং সিস্টেমেটিক হওয়ার যে শর্ত, সে শর্ত পরিপূরণ সম্পূর্ণভাবে এ মামলায় প্রমাণিত হয়েছে।'
হেলিকপ্টার থেকে চালানো গুলির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর কাছ থেকে 'ডিটেইলড ফ্লাইটের চার্টার' সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, 'সেই ফ্লাইটগুলোতে কতক্ষণ ফ্লাইটের ডিউরেশন ছিল, সেগুলো আমরা দেখিয়েছি, কোন কোনে পাইলট ফ্লাইটগুলো অপারেট করেছেন, তাদের নাম ও ফোন নম্বর আমরা দেখিয়েছি। পাইলট ছাড়া আর কোন কোন সৈনিক বা অফিসার ছিলেন, তা আমরা দেখিয়েছি।'
এছাড়া সেখানে কী কী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তোলা হয়েছে, কত রাউন্ড গুলি করা হয়েছে, সেসবের তালিকাও দেওয়া হয়েছে আদালতে।