বাংলাদেশ–তুরস্ক সম্পর্কের অগ্রগতিতে বাড়ছে বিনিয়োগ সম্ভাবনা

বাংলাদেশ–তুরস্ক সম্পর্কের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনা উন্মোচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেছেন, বাংলাদেশ এখন শুধু স্বল্পমূল্যের উৎপাদনকেন্দ্রই নয়, বরং বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কৌশলগত গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
তুরস্ক সফররত আশিক মাহমুদ ডেইলি সাবাহকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে এশিয়ার দ্রুততম বর্ধনশীল বিনিয়োগকেন্দ্রগুলোর একটি হিসেবে গড়ে তুলতে সংস্কার, ডিজিটাল উদ্ভাবন ও অংশীদারিত্বের ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
তিনি জানান, ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে ৩২ দফা সংস্কার রোডম্যাপ বাস্তবায়ন চলছে।
আশিক বলেন, 'একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে।'
২০২৪ সালের ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সংস্কারের মূল পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- অনুমতিপত্র ও কর্মভিসা ডিজিটালাইজেশন, বিডায় ইনভেস্টর রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট টিম গঠন, এবং বন্দর ও শুল্ক আধুনিকীকরণ।
মুনাফা স্থানান্তর ও বন্ড লাইসেন্স সংস্কারসহ আর্থিক পদক্ষেপগুলো ইতোমধ্যে তুরস্কের বিনিয়োগকারীদের, বিশেষ করে আর্চেলিক-মালিকানাধীন সিঙ্গার বাংলাদেশ, প্রশংসা কুড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক ভিত্তি ও কৌশল
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রয়েছে- দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬-৭ শতাংশ এবং গত বছর প্রবাসী আয় ২১ শতাংশ বেড়েছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।
আশিক বলেন, 'বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগকারীদের জন্য অপার সম্ভাবনার দেশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থান দেশের বাজারকে তিনশ' কোটি ভোক্তার জন্য উন্মুক্ত করেছে। সাম্প্রতিক সংস্কারের ফলে এ বছর প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।'
সরকার ১৯টি সম্ভাবনাময় খাতকে লক্ষ্য করে বৈদেশিক বিনিয়োগ কৌশল হাতে নিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- লজিস্টিকস, জ্বালানি, উৎপাদন ও প্রযুক্তি খাত।
সরকারের ধারাবাহিকতা, স্বচ্ছতা ও অংশীজন সম্পৃক্ততার প্রতিশ্রুতি এসব সংস্কারের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করছে।
অবকাঠামো ও চ্যালেঞ্জ
অতীতের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে আশিক বলেন, সরকার এখন নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ছে, সমুদ্র উপকূলে অনুসন্ধান চলছে। নতুন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মাস্টারপ্ল্যানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অন্তর্ভুক্তি ও জাতীয় গ্রিড শক্তিশালী করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া বন্দর সংস্কার এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরসহ নতুন টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিডা চেয়ারম্যান জানান, প্রশাসনিক জটিলতা দূর করতে কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ও কেন্দ্রীভূত বিনিয়োগকারী সেবা চালু করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ–তুরস্ক সহযোগিতা
তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিখাতকে যৌথ বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত খাতেও দুই দেশের সহযোগিতা বাড়ছে। সারাবছর চাষযোগ্য উর্বর ভূমি ও দ্রুত সম্প্রসারিত প্রক্রিয়াজাত খাদ্যবাজারে তুরস্কের কৃষি প্রযুক্তি, কোল্ড চেইন ও মূল্য সংযোজন প্রক্রিয়াজাত শিল্পের দক্ষতা বাংলাদেশের কম খরচের উৎপাদন ও কৌশলগত বাজার প্রবেশাধিকারের সঙ্গে পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।

আশিক জানান, স্বাস্থ্যসেবা, তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ও বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) খাতেও তুরস্কের বিনিয়োগের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার ব্যয় করে; যা হাসপাতাল, ওষুধ, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও ডিজিটাল স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করছে।
একই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল কর্মশক্তি, নীতিগত সহায়তা, হাইটেক পার্ক ও কর-প্রণোদনা মিলে আইটি ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ প্রবাহ
বাংলাদেশ–তুরস্ক বাণিজ্য ২০২৪ সালে এক বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। তুর্কি বিনিয়োগ এখনও তুলনামূলকভাবে সীমিত (২২০ মিলিয়ন ডলার) হলেও প্রবৃদ্ধির ধারা ইতিবাচক। কোকা-কোলা ইচেকের ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজেস অধিগ্রহণ ও আইগাজ ইউনাইটেড এলপিজির চট্টগ্রামে সম্প্রসারণ উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের উদাহরণ।
ইস্তাম্বুলে আসন্ন 'বাংলাদেশ–তুরস্ক ইনভেস্টমেন্ট সেমিনার'- অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বস্ত্র, খুচরা, বিদ্যুৎ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, আইসিটি, লজিস্টিকস, নির্মাণ, ভোগ্যপণ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও ইলেকট্রনিকস খাতে বিনিয়োগ আলোচনা ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য রয়েছে।
প্রবাসী সম্পৃক্ততা
আশিক বলেন, দেশীয় বিনিয়োগও দ্রুত বাড়ছে। পোশাক, ওষুধ, সিরামিক ও কৃষি ব্যবসায় নতুন ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি এসেছে, যা যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও সুযোগ তৈরি করছে।
বাংলাদেশ প্রায় ৭৫ লাখ প্রবাসী নাগরিককে কৌশলগত বিনিয়োগ অংশীদার হিসেবে দেখছে। প্রবাসী আয়ের অর্থকে উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে রূপ দিতে 'এনআরবি কানেক্ট ডে' ও 'শুভেচ্ছা' ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের প্রাক্কালে বাংলাদেশ এখন রপ্তানি বৈচিত্র্য, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও টেকসই বিনিয়োগে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদারে মনোযোগ দিচ্ছে।
আশিক বলেন, 'বিষয়টি সুস্পষ্ট, বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগকারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উভয়েরই আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। যারা শক্তি, ভোগ্যপণ্য বা বিশেষায়িত উৎপাদন খাতে আগেভাগে আসবে, তারাই সবচেয়ে বেশি সুফল পাবে।'
আশিক আরও বলেন, তুরস্ক এখন প্রতিরক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদার। দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগের উদ্যোগে বাংলাদেশ বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের জন্য স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—বিনিয়োগের দরজা উন্মুক্ত, আর তুর্কি বিনিয়োগকারীরাই প্রথম সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাচ্ছে।