২০২৫ সালে ভারতে ১৪৫ টন ইলিশ রপ্তানি, ৭ বছরে সর্বনিম্ন; ১ বছরে দাম বেড়েছে ২৮-৫২%

দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি ছিল ১,২০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও বাজারে সরবরাহ সংকটের কারণে এবার রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৪৫ টন, যা সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ১০৬ টন এবং আখাউড়া বন্দর দিয়ে ৩৯ টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছে।
মৌসুমের শুরু থেকেই ইলিশের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি ছিল। গত বছরের তুলনায় আকারভেদে কেজিপ্রতি ২০০ থেকে ১,০০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছিল। দুর্গাপূজার চাহিদা আরও বেড়ে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞার আগ পর্যন্ত কেজিপ্রতি ২০০–৪০০ টাকা বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হয়। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ইলিশের সরবরাহ কম ছিল। দাদন ব্যবসা, মধ্যস্বত্বভোগীদের অতি মুনাফা এবং মজুদের কারণে খুচরা বাজারে দাম আরও বেড়ে যায়। ফলে রপ্তানিকারকরা অনুমতি পেলেও পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ রপ্তানি করতে পারেননি।
মৎস্য অধিদপ্তর ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকের মধ্যে প্রথম ইলিশ রপ্তানি শুরু হয় ২০১৯–২০ অর্থবছরে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ রপ্তানি হয়েছে ২০২০–২১ অর্থবছরে। মোট ইলিশ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১,৬৯৯ টন। এর আগে, সর্বনিম্ন রপ্তানি হয়েছিল ২০১৯–২০ অর্থবছরে। রপ্তানি হয়েছিল মোট ৪৭৬ টন ইলিশ।
চট্টগ্রামের কালুরঘাটভিত্তিক প্যাসিফিক সি ফুডস এ বছর ৪০ হাজার কেজি ইলিশ রপ্তানির অনুমতি পেয়েও মাত্র ১,৫৬০ কেজি রপ্তানি করতে পেরেছে।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আবদুল মান্নান টিবিএসকে বলেন, 'স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম অনেক বেশি ছিল। মাছও কম ছিল। ভারতের বাজারে মিয়ানমারের ইলিশের দাম বাংলাদেশের তুলনায় কম হওয়ায় তারা সেখান থেকে বেশি কিনেছে।'
উল্লেখ্য, মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য ৪ অক্টোবর থেকে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা চলবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত।
নিষেধাজ্ঞার আগের দুই সপ্তাহে রাজধানীর শাহজাদপুর, উত্তর বাড্ডা, মহাখালী ও কারওয়ানবাজারে এক কেজি থেকে সোয়া এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২,২০০-২,৫০০ টাকায়। ৭০০-৯০০ গ্রামের ইলিশ ১,৮০০-২,০০০ টাকা, ৫০০-৬০০ গ্রামের ইলিশ ১,৪০০-১,৭০০ টাকা এবং ২০০-৪৫০ গ্রামের ইলিশ ৯০০-১,২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছোট ঝাটকা ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে ৬০০-৮০০ টাকায়।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও ঢাকা মহানগরীর বাজার তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আগস্টে দেড় কেজির বেশি ইলিশের দাম ছিল ১,৮০০-২,০০০ টাকা, আর এবছর আগস্টে ২,৮০০-৩,০০০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বড় ইলিশের দাম প্রায় ৫২% বেড়েছে।
এছাড়া গত বছরের তুলনায় এবছর এক কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ৮০০-৯০০ টাকা, ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজি ইলিশ ৩০০-৩৫০ টাকা, ৫০০-৭৫০ গ্রামের ইলিশ ৪০০ টাকা এবং ছোট ইলিশ ২০০-২৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে।
জেলে ও ব্যবসায়ীরা জানান, সমুদ্র ও নদীতে বড় ইলিশ দেখা যায়নি, তাই বাজারে ঝাটকা সরবরাহ বেশি। বড় ইলিশ কম থাকায় দাম বেড়েছে।
নোয়াখালীর হাতিয়ার চরচেঙ্গা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মান্নান রানা টিবিএসকে বলেন, 'সমুদ্রে ট্রলার পাঠাতে জ্বালানি ও শ্রমিকসহ খরচ প্রায় ৩.৫-৪ লাখ টাকা, কিন্তু এবার বড় মাছ পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ ছোট মাছ উঠছে, তাই বাজারে দাম বেশি।'
হাত বদলে দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে
জেলেরা মাছ ধরার পর নদীর ঘাটে ট্রলার আনার পর আড়তদারেরা তা সংগ্রহ করে নিলামের মাধ্যমে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এরপর পাইকাররা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহন করে খুচরা ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে। জেলেদের কাছ থেকে মাছ ভোক্তাদের ঘরে আসতে ৪-৬ হাত লাগে এবং প্রতিটি স্তরে প্রায় ৬০ শতাংশ দাম বাড়ে। এতে জেলেরা ন্যায্য দাম পান না, ভোক্তাকে চূড়ান্ত দাম বহন করতে হয়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন আইলিশের দাম বৃদ্ধির ১১টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এতে রয়েছে চাহিদা-সরবরাহ ভারসাম্যহীনতা, মজুত ও সিন্ডিকেট, জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, মাছ ধরার খরচ, নদীর নাব্য সংকট, অবৈধ জাল, দাদন, বিকল্প কর্মসংস্থান, নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং রপ্তানির চাপ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলেদের প্রতি কেজিতে খরচ পড়ছে ৪৭১-৫০৪ টাকা। চার থেকে ছয় হাত ঘুরে ভোক্তাদের হাতে পৌঁছানোর আগে দাম হয় ৭০০-৩,০০০ টাকা পর্যন্ত।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, 'গত পাঁচ বছরে ইলিশ আহরণ প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের জুলাই ও আগস্টে আহরণ আগের বছরের তুলনায় যথাক্রমে ৩৩ ও ৪৭ শতাংশ কম।'
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন বলেন, 'সরকারি তদারকি না থাকায় মাছ ব্যবসায়ীরা সরবরাহ ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। এটা অতিমুনাফা ছাড়া আর কিছু নয়।'
দখল-দূষণে কমছে ইলিশের বিচরণ
নাব্যতা সংকট, ডুবোচর, দখল-দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও বাঁধ-সেতু প্রভাবের কারণে নদীতে ইলিশের বিচরণ কমেছে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি স্বচ্ছ হয় এবং লবণাক্ততা থাকে না। তবে অনাবৃষ্টি ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনে পানি কমে, তাপমাত্রা বেড়ে ইলিশের সংখ্যা কমেছে।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আনিসুর রহমান বলেন, 'ইলিশ গভীর পানির মাছ। ডুবোচরে বাধা পেলে ইলিশ সমুদ্রে ফিরে যায়। বালি উত্তোলন ও দূষণের কারণে ইলিশের বিচরণ অনেক প্রভাবিত হচ্ছে। নদী বা মোহনায় অনিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো নির্মাণ, শিল্প-কারখানার দূষণ ইলিশ উৎপাদনের পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করছে।'
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমাদের যশোর প্রতিনিধি।