জুলাই সনদ বাস্তবায়নে হবে গণভোট; বিএনপি চায় নির্বাচনের দিন, জামায়াত চায় আগে
সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধনের লক্ষ্যে প্রণীত 'জুলাই সনদ' বাস্তবায়নের জন্য গণভোট আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশে চতুর্থ গণভোটের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো। তবে, এটি আয়োজনের সময় নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
রোববার (৫ অক্টোবর) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সংলাপে ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
গণভোটের সময় নিয়ে প্রধান দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। বিএনপি আগামী সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে এটি সম্পন্ন করার পক্ষে।
বাংলাদেশে এর আগে তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে—১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ সালের গণভোটে সংবিধানের সাতটি অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। আর ১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সালের গণভোট ছিল মূলত প্রশাসনিক।
এবারের প্রস্তাবিত গণভোটে ২০টি সাংবিধানিক বিষয়সহ মোট ৮৪টি ইস্যু একত্রে তুলে ধরা হবে।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কমিশনের তৃতীয় ধাপের চতুর্থ দিনের বৈঠক জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, 'জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে।'
এটি জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম পদক্ষেপ। অন্যান্য বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এসময় তিনি বলেন, 'কমিশন আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নে সরকারের কাছে এক বা একাধিক সুপারিশ দেবে। তার আগে আগামী ৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।'
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে আইনসভা গঠিত হবে সে আইনসভা জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে যে সব সংস্কার করবে তা যেন টেকসই হয়, সে ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত ঐকমত্য রয়েছে বলে জানান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
এছাড়া জাতীয় ঐকমত্য তৈরি; বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সচেষ্ট হয়ে আগের অবস্থান থেকে অনেক রাজনৈতিক দল সরে আসায় তিনি দলগুলোর প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে কমিশন খুব শিগগিরই সনদ বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তৈরি করে সরকারের কাছে দিতে পারবে।'
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, 'বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। আজকের আলোচনায় সনদ বাস্তবায়নে ১০৬ অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে বলে মনে করছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।'
তিনি বলেন, '৩০টি রাজনৈতিক দলের তিন চতুর্থাংশ দলের প্রতিনিধির নাম পেয়েছি জুলাই সনদ স্বাক্ষরের জন্য।'
জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট চায় বিএনপি
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, 'আজকের আলাপ-আলোচনায় মোটামুটি চূড়ান্ত ঐক্যমতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। গণভোটের যে প্রস্তাব এসেছে সেটা বিগত দিনে আমরাই দিয়েছিলাম।'
তিনি বলেন, 'সংসদ নির্বাচনের একই দিন একটা আলাদা ব্যালটে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।'
তিনি 'জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন অধ্যাদেশ ২০২৫' নামে একটি অধ্যাদেশ জারির পরামর্শ দেন, যা নির্বাচন কমিশনকে গণভোট পরিচালনার ক্ষমতা দেবে।
সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, গণভোট আয়োজনের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই। তার মতে, 'ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে গণভোটের বিধানটি বাতিল করেছিল, কিন্তু হাইকোর্টের এক রায়ে তা পুনর্বহাল হয়েছে। সংবিধানে এমন কোনো ধারা নেই যা গণভোট আয়োজনে বাধা সৃষ্টি করে। সুতরাং, সংসদ নির্বাচনের দিনই একটি পৃথক ব্যালটে গণভোট আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দিতে একটি অধ্যাদেশ জারি করা যেতে পারে।'
নির্বাচনের আগেই গণভোটের পক্ষে জামায়াত
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, 'জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির জন্য গণভোটের বিষয়ে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল একমত। তবে আমরা চাই, গণভোট নির্বাচনের আগেই হোক।'
তিনি বলেন, 'আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনে কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি না করে নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে গণভোট হতে পারে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেও হতে পারে। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো বাধা নেই। জনগণকে জটিল অবস্থায় না ফেলে সহজভাবে এগোলে আমরাও বাঁচি, জাতিও বাঁচে।'
হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, 'গণভোট হলে এটা কখনো চ্যালেঞ্জ করতে গেলে টিকবে না। পার্লামেন্টে এটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।'
তিনি বলেন, 'গণভোটের রেজাল্ট যদি আমাদের বিপক্ষেও যায়, আমরা এখানে ছাড় দেব। আমরা জনগণের সিদ্ধান্তকে মেনে নেব। এটি নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।'
এনসিপি ও গণঅধিকার
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার তুষার জানিয়েছেন, জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তিতে গণভোটের জন্য নির্বাচনের দিন আলাদা ব্যালট দেওয়ার প্রস্তাবকে বেশিরভাগ দল সমর্থন করেছে।
তিনি বলেন, 'ভাষাগত ভিন্নতা বাদ দিলে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে দলগুলো মোটামুটি একমত। যেখানে সনদ বাস্তবায়নে জনগণ হ্যাঁ বা না ভোট দেবে। এ ক্ষেত্রে লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের বিষয়টিও অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, সব রাজনৈতিক দল একমত হলে জনগণ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পক্ষে রায় দেবে।'
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, 'বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ৮০ শতাংশ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে। বাকি ২০ শতাংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'সরকার তিনটি দলকে গুরুত্ব দেয়। সেই তিন দলকে এক জায়গায় আনা যাচ্ছে না। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন এবং সনদের পক্ষে ভোটগ্রহণ নিয়ে সবাই একমত। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের অনুমোদন দিতে হবে।'
যেভাবে ঐকমত্যে পৌঁছাল দলগুলো
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভিন্নমতসহ সব রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর করার পর গণভোট আয়োজনের জন্য একটি সাংবিধানিক আদেশ বা অধ্যাদেশ জারি করা হবে।
বিএনপি প্রথমে দলীয় স্বাক্ষরিত অঙ্গীকারের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের অবস্থান থেকে সরে এসে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে দিনব্যাপী আলোচনার পর বিএনপি গণভোটে সম্মত হয়।
একইভাবে, সনদের জন্য একটি শক্তিশালী আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে গণপরিষদ গঠনের আহ্বান জানানো এনসিপিও গণভোটে সম্মতি দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও সাংবিধানিক আদেশের মতো বিকল্পগুলো বিবেচনা করার পর অবশেষে গণভোটের পদ্ধতিকে সমর্থন করেছে।
বৈঠকে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জোর দিয়ে বলেছে, যেহেতু সনদটিতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধন জড়িত, তাই ভবিষ্যতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক এটিকে বাতিল হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য জনগণের অনুমোদন অপরিহার্য।
জামায়াতের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে সনদটি বাস্তবায়নে 'জিগজ্যাগ' বা আঁকাবাঁকা পথ পরিহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তিনি যুক্তি দেন, ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ বিদ্যমান অনুচ্ছেদের পরিধিতে থেকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের কোনো পদক্ষেপে আদালত সমর্থন দিতে পারে না।
অতীতের যত গণভোট
এর আগে বাংলাদেশে ৩ বার গণভোট হয়েছে। এর মধ্যে ২ বার অনুষ্ঠিত হয় প্রশাসনিক গণভোট এবং একবার অনুষ্ঠিত হয় সাংবিধানিক গণভোট।
প্রথমবার জিয়াউর রহমানের সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আস্থা গণভোট, ১৯৭৭। এরপর হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে বাংলাদেশের সামরিক শাসনের গণভোট, ১৯৮৫ এবং সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সাংবিধানিক গণভোট।
- ১৯৭৭ সালের রাষ্ট্রপতি আস্থা গণভোট
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালের ২১ মে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। ওই গণভোটে ভোটারদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল 'আপনি কি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘোষিত নীতিমালা ও কর্মসূচিকে সমর্থন করেন?'
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, মোট ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৮৮ শতাংশ এবং ভোটদাতাদের প্রায় ৯৮.৮৭ শতাংশ 'হ্যাঁ'-ভোট দেন। তবে বিরোধীরা এই গণভোটকে প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ম পূর্ণ বলে দাবি করে।
জিয়াউর রহমানের জন্য এটি ছিল জনসমর্থন যাচাই-বাছাইয়ের রাজনৈতিক কৌশল, যা তাকে পরবর্তী নির্বাচনি বৈধতা অর্জনে সহায়তা করে।
- ১৯৮৫ সালের সামরিক শাসনের গণভোট
দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ, তৎকালীন সামরিক শাসক হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সময়ে। এ গণভোটের উদ্দেশ্য ছিল তার সামরিক শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা অর্জন।
নির্বাচনি কমিশনের তথ্যমতে, ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৭২ শতাংশ এবং ৯৪.৫ শতাংশ ভোটার এরশাদের পক্ষে ভোট দেন। তবে দেশজুড়ে ভোট জালিয়াতি, প্রশাসনিক প্রভাব ও বিরোধী দলের বর্জনের কারণে এই গণভোটের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে এরশাদের শাসন বৈধ করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন।
- ১৯৯১ সালের সাংবিধানিক গণভোট
বাংলাদেশের সর্বশেষ গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরের বিষয়ে জনগণের মতামত নেওয়া।
ভোটারদের কাছে প্রশ্ন ছিল 'আপনি কি সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন সম্মত?'
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৮৪ শতাংশ ভোটার অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৮৮.৫ শতাংশ সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দেন। এই গণভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নির্ভর সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হয়, যা আজও চলমান।
