সরবরাহ চেইনে পাঁচ হাত ঘুরে ৬০ শতাংশ করে দাম বাড়ে ইলিশের: বিটিটিসি

বাজারে পৌঁছানোর আগেই অদক্ষ সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিটি পর্যায়ে দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশিদের পছন্দের মাছ ইলিশ ক্রমেই সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ইলিশ ধরে আড়ত পর্যন্ত নিয়ে আসতে জেলেদের প্রতি কেজিতে গড়ে খরচ পড়ছে ৪৭১ থেকে ৫০৪ টাকা। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) এক নতুন সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
জেলেদের কাছ থেকে এই মাছ ভোক্তার ঘরে যাচ্ছে কমপক্ষে পাঁচ হাত ঘুরে। আর প্রতি হাতে ৬০ শতাংশ করে দাম বাড়ছে। ফলে প্রতি কেজি ইলিশ আকার ভেদে ৭০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দরে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
এই সমীক্ষা করতে চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার জেলার বড় বড় আড়ৎ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছে বিটিটিসি। এতে মাছ ধরা থেকে শুরু করে পরিবার পর্যন্ত সম্পূর্ণ সরবরাহ চেইন পরীক্ষা করা হয়েছে।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ছোট, মাঝারি ও বড় নৌকা বা ফিশিং ট্রলারে ইলিশ ধরা হয়। ছোট নৌকায় যারা মাছ ধরে, তাদের প্রতি কেজি ইলিশ ধরতে খরচ হয় ৪৮৪ টাকা। মাঝারি নৌকার প্রতি কেজি মাছ ধরার খরচ পড়ে ৫০৪ টাকা। আর বড় নৌকা বা ফিশিং ট্রলারে প্রতি কেজি ইলিশ ধরতে খরচ হয় ৪৭১ টাকা।
এই মাছ জেলের হাত থেকে প্রথমে আসে মাছঘাটের মহাজনের কাছে। এরপর যায় আড়তদারের হাতে। আড়তদার থেকে পাইকারি ব্যবসায়ী হয়ে আসে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। এই পাঁচ ধাপের প্রতিটিতে ৫৯-৬০ শতাংশ হারে দাম বাড়ে বলে ট্যারিফ কমিশনের সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
ঢাকার খুচরা বাজারেও এই মূল্য বৃদ্ধির প্রতিফলন দেখা গেছে। ঢাকার বাজারগুলোতে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি ৬০০-৬৫০ টাকা কেজি, ৫০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০-৮০০ টাকা কেজি। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজি, ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, ১ কেজি থেকে ১.৫ কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং ১.৫ কেজি ওজনের ইলিশ ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বিটিটিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইলিশ মাছ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে উচ্চ হারে দাম বৃদ্ধির কারণে ভোক্তা পর্যায়ে দাম অস্বাভাবিক হচ্ছে। ইলিশের বেশি দামের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে যেসব দাদন ব্যবসায়ী জেলেদের পেছনে বিনিয়োগ করেন, তারা নদীর ঘাটে মাছ বিক্রির সময় ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দর ঠিক করে দেন। দাদন ব্যবসায়ীদের ঠিক করা ফ্লোর প্রাইসের কমে বিডিং করতে পারেন না আড়তদার বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা, কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি, মজুত ও সিন্ডিকেট এবং জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যের কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণেও ইলিশের দাম বাড়ছে। এছাড়া জেলেদের মজুরি, ট্রলার বা নৌকার রক্ষণাবেক্ষণ, জাল মেরামত, বরফ ও অন্যান্য উপকরণের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে ইলিশ আহরণের খরচ বেড়েছে।
রপ্তানি নীতির কারণেও স্থানীয় সরবরাহে প্রভাব পড়ছে। এ বছর সরকার ১ হাজার ২০০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ৯৭.৩৬ টন ইলিশ রপ্তানি করেছে। প্রতি কেজি মাছ রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৫৩৩.৯০ টাকায়। কমিশন বলেছে, এই দরে রপ্তানি করে ব্যবসায়ীদের লাভ হচ্ছে। ফলে স্থানীয় বাজারে ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিক হারে মুনাফা করছে বলে প্রতীয়মাণ হয়।
সুপারিশ
ইলিশের বাজারমূল্য যৌক্তিক করার জন্য কিছু সুপারিশও করেছে বিটিটিসি। তাদের প্রথম সুপারিশ হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমানো। সেজন্য জেলেদের মধ্যে সমবায় সমিতি গঠন উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
এছাড়া বিক্রির জন্য অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি, সরকারি বিশেষ উদ্যোগে বড় বড় শহরে ইলিশের বিপণন কেন্দ্র স্থাপন, মাছের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য প্রধান প্রধান ইলিশ সরবরাহকারী এলাকায় কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন ও রেফ্রিজারেটর ভ্যানের ব্যবস্থা করার পরামর্শ এসেছে।
সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সরবরাহ চেইনে জড়িত আড়তদার ও পাইকারদের বাধ্যতামুলক রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে বিটিটিসি।
দাদনদারদের প্রভাব কমাতে সহজে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা, মাছ বিক্রিতে ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা নিরুৎসাহিত করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
সবশেষে সংস্থাটি বলেছে, ইলিশের আকার অনুযায়ী সরকার দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে। এতে ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা নিরুৎসাহিত হওয়ার পাশাপাশি জেলেরা নায্য দাম পাবেন, ভোক্তারাও প্রকৃত বাজারমুল্যে কিনতে পারবেন।
বিটিটিসি চেয়ারম্যান মইনুল খান সাংবাদিকদের বলেন, খুচরা পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলে জেলেদের লোকসান হবে না। এই মাছের বাজারে নানান কারসাজি রয়েছে। মূলত মধ্যস্বত্বভোগীরা এই কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে থাকেন।
দেশে যত মাছ উৎপাদন হয়, তার ৪২ শতাংশ আসে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে। এরমধ্যে ১২ শতাংশ ইলিশ মাছ। দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ পাওয়া যায় বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে। একক জেলা হিসেবে ভোলা সবচেয়ে বেশি ইলিশ উৎপাদন করে।
দেশে যত ইলিশ ধরা পড়ে তার ৬০ শতাংশ সমুদ্র থেকে, ২৫ শতাংশ নদীর মোহনা ও ১৫ শতাংশ নদী থেকে আসে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের জেলেরা ৫.২৯ লাখ টন ইলিশ আহরণ করেছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৫.৭১ লাখ টন।
পরের বছরে ইলিশ মাছ ধরার পরিমাণ কমেছে। যদিও বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় ও নদীতে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বছরে দুইবারে ২২ দিন করে মোট ৪৪ দিন ইলশ ধরা বন্ধ রাখা হয়। এই সময়ে যেসব জেলেরা ইলিশ ধরেন তাদের বিশেষ সহায়তাও করে থাকে সরকার। এরপরও ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
পদ্মা, মেঘনা, তেতুলিয়া, কীর্তনখোলা নদীতে বেশি পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যায়। এসব নদীর জলজ পরিবেশ দূষণের কারণে মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সময়ে এসব নদীতে আসছে কম।
ট্যারিফ কমিশনের বিশ্লেষণ বলছে, আগের সময়ের তুলনায় চলতি বছর জুলাইয়ে দেশের নদীতে ইলিশের সরবরাহ বা উপস্থিতি দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে।