স্বর্ণের রমরমার বছর: কেন দামের নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ছে বুলিয়ন

গত কয়েক দশকের মধ্যে স্বর্ণের জন্য এবছরই যেন সেরা। ২০২৫ সালে একের পর এক রেকর্ড ভাঙছে স্বর্ণের দাম, যা এটিকে ১৯৭৯ সালের পর সবচেয়ে শক্তিশালী বার্ষিক পারফরম্যান্সের দিকে নিয়ে যাচ্ছে—ওই বছরেই ইরানের ইসলামী বিপ্লব বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
কেন স্বর্ণের এত চাহিদা?
সোজা উত্তর হলো—স্বর্ণ আবারও তার প্রাচীন ভূমিকা পালন করছে: সঞ্চয়ের নিরাপদ আশ্রয় ও মূল্য সংরক্ষক হিসেবে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে লিডিয়ার রাজ্য স্বর্ণমুদ্রা চালুর পর থেকেই বহুমূল্য ধাতুটি এ ভূমিকা রাখছে।
আজকের দিনে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা থেকে শুরু করে রাশিয়া-ন্যাটোর ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন অনেক কারণেই বিনিয়োগকারীরা সহজেই আতঙ্কিত হন, এসবই ভূমিকা রাখে অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থেকে সরে গিয়ে স্বর্ণে অর্থ ঢালার।
প্রচলিত মূল্য নির্ধারক যেমন সুদের হার, ডলার ও মুদ্রাস্ফীতির পাশাপাশি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর আক্রমণ, বাণিজ্যযুদ্ধ, কর ও ব্যয় পরিকল্পনা—এসবও স্বর্ণের দাম বাড়াচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
অন্যান্য মূল্যবান ধাতু স্বর্ণের সমান ভূমিকা পারে না?
চাহিদার তুলনায়, স্বর্ণের অভাবই তাকে বিশেষ করেছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের হিসাবে, ইতিহাসে উত্তোলিত সব স্বর্ণ একত্র করলে একটি মাত্র ঘনক্ষেত্র তৈরি হবে, যার প্রতিটি দিক মাত্র ২২ মিটার লম্বা।
প্রতিবছর স্বর্ণের বৈশ্বিক সরবরাহ বাড়ে আনুমানিক ১.৭ শতাংশ হারে। অর্থাৎ কোনো নীতি, কোনো নতুন আবিষ্কার বা "ভূতত্ত্বের কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং" স্বর্ণের মান সেভাবে কমাতে পারে না। এ কারণেই যখন সরকারগুলো কর বাড়াতে বা ব্যয় কমাতে রাজনৈতিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন স্বর্ণ হয়ে ওঠে আরও আকর্ষণীয়।
অপরদিকে তামা বছরে বিপুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয় এবং চাহিদা নির্ভর করে বৈশ্বিক অর্থনীতির স্বাস্থ্যের ওপর। প্লাটিনাম ও প্যালাডিয়ামও একই সমস্যায় ভোগে—শিল্প উৎপাদনে এগুলোর ব্যাপক চাহিদাই দ্রুত নতুন জোগানকে শোষণ করে নেয়।
স্বর্ণের দর কতটা বেড়েছে—এবং এটাই কি শীর্ষ বিন্দু?
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে স্বর্ণের দাম ৪৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে আউন্সপ্রতি ৩,৭৬০ মার্কিন ডলারে—যা এ বছর অন্য সব প্রধান সম্পদ শ্রেণির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
১৯৭৯ সালের পর এমন শক্তিশালী বছর আর আসেনি। সে সময় ইরানের বিপ্লব তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আশাকে ধূলিসাৎ করেছিল। ফলে বিনিয়োগকারীরাও স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে পড়লে এর দামে স্ফীতি দেখা দেয়।
ব্যাংক অব আমেরিকার (বিওএফএ) তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহেই ৫.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে স্বর্ণে। আর গত চার সপ্তাহে রেকর্ড ১৭.৬ বিলিয়ন ডলারের প্রবাহ হয়েছে স্বর্ণ ক্রয়ে। যদিও বিওএফএ সতর্ক করছে, স্বর্ণ কৌশলগতভাবে "অতিরিক্ত কেনা" হলেও কাঠামোগতভাবে এখনো "কম মালিকানাধীন"—ব্যক্তি গ্রাহকের পরিচালিত সম্পদের মাত্র ০.৪ শতাংশ হলো স্বর্ণ। তাদের মতে, স্বর্ণের দাম আরও বাড়বে।
মার্কিন বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক সংস্থা– ইনভেস্কো -এর সামষ্টিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ অর্নব দাস বলছেন, এ দৌড়ের এখনো "পা আছে"। তার মতে, "আমরা মার্কিন ঝুঁকির বিরুদ্ধে স্বর্ণের বিকল্প দেখি না। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও ডলার বাদে অন্য কোনো বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না বলেই তারা স্বর্ণ কিনছে।"
কারা কিনছে? কেন কিনছে?
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল জানাচ্ছে, পশ্চিমা বিনিয়োগকারী ও বাজার পূর্বানুমানকারীরা সাম্প্রতিক দাম বাড়ার মূল চালক।
দুটি কারণ সামনে এসেছে। প্রথমত, মার্কিন অর্থনীতি মন্থর হওয়ার প্রমাণ মিলছে, যা ফেডারেল রিজার্ভকে আরও সুদ কমানোর সুযোগ দিচ্ছে। এর মানে নগদ অর্থ (ডলার) রাখার আকর্ষণ কমছে, আর স্বর্ণ তুলনামূলকভাবে বেশি আকর্ষণীয় হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ফেডের স্বাধীনতা নিয়ে সংঘাত — ডলার ও মার্কিন ট্রেজারি বাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিজার্ভে স্বর্ণের অংশ বাড়িয়ে চলেছে, বিশেষত চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা উল্লেখযোগ্য। প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক খবরে বলা হয়েছে, চীন বৈশ্বিক স্বর্ণের বাজারে নিজের অবস্থান শক্ত করতে বিদেশি রিজার্ভের কাস্টডিয়ান হওয়ার চেষ্টা করছে—এতে তারা ডলার ও পশ্চিমা অর্থনৈতিক কেন্দ্র যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারবে।
ট্রাম্পের প্রভাব কী?
এ বছর যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩০-এর দশকের পর বৈদেশিক বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর সবচেয়ে বেশি শুল্ক বসালেও বাজার ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে মার্কিন ডলারে।
এমঅ্যান্ডজি ফান্ড ম্যানেজার ইভা সান-ওয়াই বলছেন, এটি "বৃহত্তর ডি-ডলারাইজেশন প্রবণতা" তৈরি করেছে, যা বাজারে অস্থিরতা এনেছে। তার ভাষায়, "এই কারণেই স্বর্ণকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে।"
২০২৫ সালে এসে মার্কিন ডলার মার খাচ্ছে—এখন পর্যন্ত ৯ শতাংশ কমে গেছে এর দর। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা ফেডের স্বাধীনভাবে পরিচালনা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে টানাপোড়েন ও ও বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগই এর কারণ। আর এতে স্বর্ণের দাম ডলারের হিসাবে বেড়ে যাচ্ছে।
এখন কি স্বর্ণ কেনা উচিত?
"সতর্ক থাকুন"—এটাই মূল কথা, কারণ অনেকে আশঙ্কা করছেন এই সম্পদের দাম হয়তো অনেক বেশি বেড়ে গেছে। তবে ডয়েচে ব্যাংক সম্প্রতি ২০২৬ সালের স্বর্ণের দামের পূর্বাভাস ৩০০ ডলার বাড়িয়ে আউন্সপ্রতি ৪,০০০ ডলার করেছে।