ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইনসেপ্টার উত্থান যেভাবে

বাংলাদেশ সম্ভবত ভ্যাকসিন খাতে বড় এক পরিবর্তনের সামনে দাঁড়িয়ে। দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস এমন সক্ষমতা তৈরি করেছে, যাতে মানুষের জন্য ১৬ ধরনের এবং প্রাণীর জন্য ১৩ ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদন করা সম্ভব। এতে একদিকে যেমন দেশের হাজার হাজার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে দেশের বাজারে কম খরচে ভ্যাকসিন পাওয়া সম্ভব হবে।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস বিশ্বব্যাপী এমআরএনএ টেকনোলজি হাবের মর্যাদাপূর্ণ তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছে। এ তালিকায় মাত্র ১৫টি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক রয়েছে। তালিকায় স্থান পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা। এই হাবের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ভবিষ্যতে আবার যদি কোনো মহামারি বা নতুন রোগ দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে নতুন যেকোনো ভ্যাকসিন দ্রুততম সময়ের মধ্যে তৈরি করতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি।
করোনা মহামারির পর ২০২১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) উদ্যোগে এই হাব চালু করা হয়। এর লক্ষ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করা, যাতে তারা ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার মতো উন্নত ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল মুক্তাদির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা এখন যেকোনো বায়োলজিক্যাল ও এনিম্যাল ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষম। বর্তমানে দেশে যেকোনো ভ্যাকসিনের চাহিদার শতভাগ আমরা পূরণে সক্ষম।'
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
ব্যাপক সহায়তা পাওয়ার পরেও বাংলাদেশ শুধু করোনা ভ্যাকসিনের পেছনেই খরচ করেছে ৪০ হাজার কোটি টাকা (৩.৭ বিলিয়ন ডলার)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রতি বছর ভ্যাকসিন আমদানির খরচ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। ইনসেপ্টার আত্মনির্ভরশীল হওয়ার উদ্যোগ এই ব্যয় অনেকটা কমাতে পারে এবং একই সঙ্গে অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়ক হবে।
নিউমোনিয়া
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিউমোনিয়ায় প্রতি বছর বাংলাদেশে ২৫ হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। এতদিন রোগীদের আমদানি করা ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করতে হতো, যেখানে এক ডোজের দাম পড়ত ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর বাজারে ভ্যাকসিনের সংকট তো প্রায়ই দেখা যেত। ২০২৪ সালে নিউমোনিয়া ও নিউমোকক্কাল প্রতিরোধী 'এভিমার-১৩' নামে একটি ভ্যাকসিন বাজারে আনে ইনসেপ্টা ফার্মাসিটিক্যালস। এই ভ্যাকসিনের দাম চার হাজার টাকা। এতে একদিকে যেমন খরচ কমেছে, অন্যদিকে বাজারে যে প্রায়ই সংকট দেখা যেত, সেটিও আর নেই।
জরায়ুমুখ ক্যান্সার
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ভ্যাকসিনের একমাত্র পরিবেশক ছিল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বা জিএসকে। ২০১৫ সালে জিএসকে বাংলাদেশে ব্যবসা বন্ধ করলে সংকটে পড়ে মরণব্যাধি ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা। দীর্ঘদিন বেশি দামে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে ইনসেপ্টার কারখানায় উৎপাদন হয় এই ভ্যাকসিন। দাম সেই ২০১৫ সালে বিক্রি হওয়া জিএসকের ভ্যাকসিনের চেয়েও অন্তত ৪০ শতাংশ কম।
জলাতঙ্ক
দেশের আরেকটি সাধারণ ব্যাধি জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন সংকট নিয়েও প্রায়ই গণমাধ্যমে সংবাদ হতো। সরকার আমদানি করে বিনামূল্যে এই ভ্যাকসিন দিলেও প্রাপ্যতা সংকটে অবৈধভাবে বিক্রি হতো বেশি টাকায়। তবে এ সমস্যারও সমাধান দিয়েছে ইনসেপ্টা। ২০১২ সালে উৎপাদন শুরু করার পর থেকেই হাসপাতালগুলোতে এই ভ্যাকসিন এখন সহজলভ্য।
ক্ষুদ্র থেকে বিশ্ব দরবারে
রাজধানী ঢাকার অদূরে জিরাবো এলাকায় অবস্থিত ভ্যাকসিন প্লান্টটি সর্বাধিক প্রযুক্তিতে নির্মিত। ২০১১ সালে প্রথম টাইফয়েড ভ্যাকসিন (ভ্যাক্সফয়েড), রেবিস ভ্যাকসিন (রেবিক্স-ভিসি) এবং টিটেনাস ভ্যাকসিন (ভ্যাকসিটেট) উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে এখানে রেবিস, রেবিস-আইজি, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-এ, টাইফয়েড, টিটেনাস, টিটেনাস-আইজি, মিজেলস-রুবেলা, অ্যান্টিভেনাম, ফ্লু ও মেনিনজাইটিসসহ প্রায় সব ধরনের হিউম্যান ভ্যাকসিন উৎপাদন হচ্ছে।
ইনসেপ্টার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ম্যানেজার (ভ্যাকসিন) ফারহানা লাইজু বলেন, 'প্রতি বছর হজের জন্য প্রায় এক লাখের মতো ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হয়। সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসায় যে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়, আমরাই সেটা সরবরাহ করি।' তাদের প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৮ কোটি সিঙ্গেল ডোজ বলেও জানান তিনি।
এছাড়া ইনসেপটা টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করেছে এবং এখন এইচপিভি-৪, নিউমোকক্কাল (পিসিভি), ডেঙ্গু ও রোটাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরির কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ১৬ ধরনের ভ্যাকসিন ও ইমিউন গ্লোবিউলিন (আইজি) পণ্য তৈরি করছে। এর মধ্যে চারটি ভ্যাকসিন— মেনিনগোকক্কাল (এসিওয়াই ডব্লিউ১৩৫), হেপাটাইটিস-বি, কলেরা ও র্যাবিস। এগুলো প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব বাল্ক অ্যান্টিজেন দিয়ে তৈরি।
রয়েছে পশুর ভ্যাকসিনও
২০১৪ সালে ইনসেপ্টা এনিম্যাল ভ্যাকসিন ডিভিশন চালু করা হয়, যেখানে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কাজ করা হচ্ছে। ৯৬ হাজার বর্গফুটের এই স্থাপনায় বছরে ৫৮৮ কোটি ডোজ লাইভ ভ্যাকসিন ও ৬৫ কোটি ডোজ ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রাণিস্বাস্থ্য ভ্যাকসিনের বাজার বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ১০ হাজার কোটিতে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইনসেপ্টা ইতোমধ্যেই ১২টি পোল্ট্রি ভ্যাকসিন ও একটি গবাদিপশুর ভ্যাকসিন বাজারে এনেছে। এগুলোর সবই গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস (জিএমপি) ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে তৈরি। একই সঙ্গে গুণগত মান নিশ্চিতে ডাব্লিউওএএইচের (ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমাল হেলথ) নির্দেশিকা মেনে চলা হয়, কোল্ড চেইন বজায় রাখা (২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং কাঙ্ক্ষিত অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে পরীক্ষা চালানো হয়।
ভ্যাকসিন তৈরিতে চ্যালেঞ্জ: যেভাবে শুরু
ভ্যাকসিন তৈরিতে বিনিয়োগ বেশি লাগে। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন ম্যানুফ্যাকচারিং এক্সপার্টটাইজ কম, সময় অনেক দিতে হয়। সে কারণে ফার্মা কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিন তৈরিতে আগ্রহী নয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ইনসেপ্টা।
আব্দুল মুক্তাদির বলেন, শুরুটা হলো আইসিডিডিআর,বির প্রেরণা থেকে। পৃথিবীতে যত ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হতো, তার প্রায় সবগুলো নিয়েই গবেষণা করতে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে কলেরা ভ্যাকসিন নিয়ে তাদের গবেষণাকে পাইওনিয়র বলা যায়। দেশে ভ্যাকসিনের সায়েন্টিস্ট ড. ফেরদৌস কাদরী আমাকে প্রথম কলেরা ভ্যাকসিন বানানোর অনুরোধ করেন।
তিনি বলেন, 'উনি (ড. ফেরদৌস) শুধু কলেরার ভ্যাকসিনের জন্য আমার কাছে ছোট একটা ফ্যাসিলিটি চেয়েছেন। তবে আমি সাসটেইনেবল ভ্যাকসিন উৎপাদনের কথা ভেবেছি। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত জাপানসহ অনেক দেশ ঘুরেছি। অক্সফোর্ড, লিডসসহ বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে ঘুরে অভিজ্ঞতা নিয়েছি এবং মনে সাহস পেয়েছি।'
'২০১১ সালে আমরা শুরু করি এবং ২০২২ সালে এসে আমাদের কাজ পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। শুরুতে সব সায়েন্টিস্ট বিদেশ থেকে হায়ার করতে হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি সায়েন্টিস্টদের খুঁজে খুঁজে আনা হয়েছে। আমরা এখন মানুষের জীবন রক্ষায় যেকোনো ভ্যাকসিনই উৎপাদন করতে পারব,' যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'আমরা একদিকে দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি, অন্যদিকে কয়েক হাজার সায়েন্টিস্ট তৈরি করেছি। বর্তমানে আমাদের ফ্যাক্টরিতে ৪৫০-৫০০ সায়েন্টিস্ট কাজ করছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১০০ এর বেশি সায়েন্টিস্ট গিয়েছেন আমাদের এখান থেকে।'
গবেষণা ও বৈশ্বিক সহযোগিতা
ইনসেপ্টার ১০ হাজার বর্গফুটের আধুনিক গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) ইউনিটটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত এবং ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফর্মুলেশন ও শেয়ার্ড ফ্যাসিলিটিজে বিভক্ত, যা প্রোটিন ও পলিস্যাকারাইড পরিশোধন, কনজুগেশন এবং সেল ব্যাংকিংসহ নানা অত্যাধুনিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম করে তুলেছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রি-ক্লিনিক্যাল ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত হয় এবং বাজারজাত সব ভ্যাকসিনে ফার্মাকোভিজিল্যান্স বজায় রাখা হয়।
ইনসেপ্টা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছে—এর মধ্যে আছে আইভিআই, পাথ, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, আইসিডিডিআর,বি এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এসব সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে উদ্ভাবনী ভ্যাকসিন তৈরি ও বৈশ্বিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের টিকা সহজলভ্য করার পথ তৈরি হচ্ছে।
ভ্যাকসিন বাজারের পরিসর
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্যমতে, প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ নবজাতকের জন্ম ও নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির কারণে বাংলাদেশ একটি বড় ভ্যাকসিন বাজার হিসেবে গড়ে উঠেছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রায় ১৬ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৮৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে ভ্যাকসিন সরবরাহ ও লজিস্টিক খাতে।
শিল্পখাতের হিসাব বলছে, বেসরকারি হাসপাতালসহ বাংলাদেশের মোট ভ্যাকসিন বাজারের আকার প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (আইপিএল) বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। এটি বিশেষায়িত জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে। ১০ হাজারেরও বেশি কর্মী রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এটি বর্তমানে ১ হাজার ২৭৯টি জেনেরিক ওষুধ সরবরাহ করছে।
ইনসেপ্টা ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও তুরস্কসহ ৮৯টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে এবং আরও ৩০টি দেশে বাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে ইউনিসেফ ও অন্যান্য জাতিসংঘ সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে ওষুধ সরবরাহ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।