খাগড়াছড়ির রামসু বাজার এখন ধ্বংসস্তূপ; পুড়েছে ২৫ কোটি টাকা মূল্যের ৮৫ দোকান-বসতঘর

খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলা সদরের থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রামসু বাজার একসময় ছিল মারমা সম্প্রদায় অধ্যুষিত সমৃদ্ধ একটি বাজার। এখানে দোকানিরা মুদি ও পোশাকের দোকান থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করতেন।
চারপাশের পাঁচটি এলাকার হাজার হাজার মানুষ এই বাজারের ওপর নির্ভর করত সব ধরনের পণ্যের জন্য। গত দুই দশকে মারমা সম্প্রদায় এই বাজারকে স্বনির্ভর করার দিকে অনেকটাই এগিয়েছিল।
তবে এখানে শুধু মরমা সম্প্রদায়ই ছিল না; বাঙ্গালীসহ অন্যান্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাজারে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল।
তবে ২৮ সেপ্টেম্বর ঘটে যাওয়া এক অভূতপূর্ব সংঘাতের পর পুরো রামসু বাজার এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে চলতে থাকা অবরোধের প্রেক্ষিতে সংঘটিত এই সংঘাতে তিনজন নিহত এবং অন্তত ১৬ জন আহত হয়েছেন।
একই সময়ে দুর্বৃত্তদের জ্বালানো আগুনে অন্তত ৮৫টি দোকান ও বাড়ি, পাঁচটি এনজিও অফিস এবং একটি হলুদ গুদাম ধ্বংস হয়ে গেছে। স্থানীয় সূত্রের মতে, প্রাথমিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম–খাগড়াছড়ি সড়ক থেকে একটি সেতুতে প্রবেশ করলে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নজরে আসে। সড়কের বাম পাশে তিনতলা একটি ভবন, যেটি স্থানীয়দের কাছে শিবু ঘোষের ভবন নামে পরিচিত। ভবনটির মাটির তলার দেয়ালে এখনো গুলির স্পষ্ট চিহ্ন দেখা যায়।
এই ভবনে যুব উন্নয়ন বিভাগ, সমাজসেবা বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়, মহিলা বিষয়ক কার্যালয়, তথ্য আপা অফিস, খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, সূর্যের হাসি ক্লিনিক এবং এনআরডিএস সহ নয়টি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার অফিস রয়েছে।
তিনতলার প্রতিটি কক্ষের সব জানালা ভাঙা। পুরো ভবন আগুনে পুড়েছে। কাচের টুকরো বাইরে ছড়িয়ে আছে। সিঁড়ির মধ্যে রাখা আটটি মোটরসাইকেল পুড়ে ছাই, শুধুমাত্র সেগুলোর অবশিষ্টাংশ আছে।
সিঁড়ির টাইলস আগুনে ভেঙে গেছে। আগুনের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, সিঁড়ি পুরো অন্ধকারে ঢাকা। মোবাইলের আলো ব্যবহার করে উপরে গেলে দেখা যায়, প্রতিটি কক্ষ তালাবদ্ধ এবং দেয়াল আগুনে কালো হয়ে গেছে। ভবনের পাশে গ্যারেজে রাখা তিনটি মোটরসাইকেলও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
একটু দূরে রয়েছে কংক্রিটের তৈরি হলুদের গুদাম, সেটিও আগুনে পুড়েছে। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নেভেনি, ধোঁয়া উঠছিল।
রামসু বাজারের প্রবেশ পথের ডান পাশে একটি স-মিল (করাতকল) রয়েছে। সেটিও আগুনে পুড়েছে। সেতুর কাছে থাকা স-মিলের একটি কক্ষ পুড়ে গেছে, ধোঁয়া উঠছে। আরেকটি দুইতলা ভবন ভাঙচুর করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই ভবন, স-মিল ও গুদামের মালিক সুমন ঘোষ ও গণেশ ঘোষ টিবিএসকে বলেন, রোববারের সহিংসতার সময় তারা ব্যবসাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তবুও কেউ তাদের সম্পত্তি জ্বালিয়ে দিয়েছে, যার আনুমানিক ক্ষতি ৫ কোটি টাকা।
হলুদ গুদামের মালিক ঝন্টু পাল বলেন, এখানে প্রায় ৩০০ টন হলুদ সংরক্ষিত ছিল। আগুনে সব হলুদ পুড়ে গেছে, যার ক্ষতি ৭ কোটি টাকারও বেশি।
সামনের দিকে এগিয়ে গেলে ধ্বংস আরও স্পষ্ট হয়ে ওথে। পাশের দোকানগুলোর পণ্য সম্পূর্ণভাবে ছাই হয়ে গেছে, অবকাঠামোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ দোকান সম্পূর্ণভাবে ছাই হয়ে গেছে, কেবল দুমড়ানো-মোচড়ানো টিনের অংশ অবশিষ্ট আছে। সড়কের দুপাশে অন্তত দশটি মোটরসাইকেলের পোড়া অবশিষ্টাংশ দেখা গেছে।
মিসেন রাখাইন নামের এক দোকানি বলেন, তিনি দুটি পাশাপাশি দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন; একটিতে পোশাক ও টেইলারিং ব্যবসা চালাতেন এবং অন্যটিতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন। সংঘর্ষের সময় গুলির শব্দ শুনে তিনি দোকান বন্ধ করে পালিয়ে যান। ফিরে এসে দেখেন সব পণ্য লুটপাট হয়েছে এবং আগুনে পুড়েছে।
তিনি বলেন, 'আমার প্রায় ২০ লাখ টাকার পণ্য ছিল। অনেকেই প্রবারণা পূর্ণিমার জন্য পোশাক অর্ডার দিয়েছিলেন। সবই ছাই হয়ে গেছে। এখন আমি আমার গ্রাহকদের কী জবাব দেব?'
বাজারে ষাটোর্ধ্ব ক্যান্সার আক্রান্তা অংসানু মারমার দোকান ছিলো তিনটি। একটিতে নিজে কাপড়ের দোকান করতেন। বাকি দুটি ভাড়া দিয়েছিলেন। দোকানের আয় থেকে চলত তার সংসার ও চিকিৎসা ব্যয়। সবগুলো দোকান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'আজ চেকআপে জন্য আমার চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল। প্রতিহিংসার আগুন আমার সব কেড়ে নিয়েছে। এখন কীভাবে নিজের চিকিৎসা চালাবো আর কীভাবে সংসার চালাবে একমাত্র ভগবানই জানেন।'
এক ছোট দোকানি, যে চা ও নাস্তা বিক্রি করত, কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করত। সংঘাতের সময় তার সব পণ্য লুটপাট হয় এবং পুড়ে গেছে, ঘরে রাখা চালও পুড়ে গেছে। এখন তার খাবার রান্না করার উপায় নেই।
মঙ্গলবার সকাল থেকে গুইমারা উপজেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ও দোকান পরিদর্শন করে প্রাথমিক ক্ষতির পরিমাণ যাচাই করছেন।
একজন কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল করিম টিবিএসকে বলেন, 'এ পর্যন্ত আমরা ৮৫টি ক্ষতিগ্রস্ত দোকান ও বাড়ি শনাক্ত করেছি। মোট ক্ষতি ২৫ কোটি টাকার বেশি হতে পারে। হলুদ গুদামের মালিক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সংঘাতের পর যারা পালিয়ে গেছেন, তাদের অনেক এখনও ফিরে আসেনি। তাই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এবং মোট ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।'