জাহাজ রিসাইক্লিংয়ে শীর্ষে বাংলাদেশ, তবে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব কমেছে

টানা সাত বছর ধরে বিশ্বের শীর্ষ শিপ রিসাইক্লিং বা জাহাজ পুনর্ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে ২ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন গ্রস টন জাহাজ রিসাইকেল হয়েছে দেশে, যা বিশ্বে মোট রিসাইক্লিংয়ের ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ।
তবে বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জাহাজ রিসাইক্লিংয়ের পরিমাণ ২০২৩ সালের তুলনায় ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ সালে ৩ দশমিক ৪২ মিলিয়ন গ্রস টন জাহাজ রিসাইকেল হলেও ২০২৪ সালে তা নেমে আসে ২ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন টনে। এতে বৈশ্বিক অংশীদারিত্বও কমে দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৪৩ দশমিক ২ শতাংশে।
'রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০২৫' শীর্ষক প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমানে সবুজ জাহাজ পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থায় রূপান্তরের পথে রয়েছে। ২০২৪ সালে বিশ্বের মোট বাল্ক ক্যারিয়ারের ৬৭ শতাংশ, তরল গ্যাসবাহী জাহাজের ৫৮ শতাংশ এবং তেলবাহী ট্যাঙ্কারের ৪২ শতাংশ রিসাইক্লিং করেছে বাংলাদেশ।
এর আগে ২০২৩ সালে জাহাজ পুনর্ব্যবহারবিষয়ক জাতিসংঘের চুক্তি, 'হংকং কনভেনশন' অনুমোদন করে সরকার। এর মাধ্যমে ২০২৫ সালের ২৬ জুন থেকে চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার পথ সুগম হয়। এ কনভেনশনে বলা হয়েছে, জাহাজগুলোকে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে ভাঙতে হবে।
তবে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ অনেক দেরিতে সবুজ জাহাজ পুনর্ব্যবহার খাতে প্রবেশ করেছে। তুরস্কের আলিয়াগা শহরের শিপ ব্রেকিং (জাহাজ ভাঙা) ইয়ার্ডগুলো হংকং ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন—উভয় মানদণ্ডই পূরণ করে। অন্যদিকে ভারতের আলাং এলাকায় ইতোমধ্যে ১০০-রও বেশি ইয়ার্ড আন্তর্জাতিক সনদ পেয়েছে।
দেরিতে শুরু করলেও বাংলাদেশ ধীরে ধীরে অগ্রগতির পথে এগোচ্ছে। বর্তমানে দেশের ১৫৩টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মধ্যে ১৪টি ইতোমধ্যে সনদপ্রাপ্ত হয়েছে, আরও ২০টি ইয়ার্ড সনদ পাওয়ার পথে রয়েছে।
দায়িত্বশীলভাবে জাহাজ ভাঙার ক্ষেত্রে উন্নয়ন সংস্থা, ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি ও জাহাজ মালিকদের সহযোগিতা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বাজারে আরও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সহায়তা করছে।
তবে সবুজ প্রযুক্তি গ্রহণের পথে বড় বাধা হলো উচ্চ ব্যয়। একটি ইয়ার্ড আধুনিকায়নে খরচ হতে পারে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকারও বেশি। এর পাশাপাশি অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরির মতো চ্যালেঞ্জ তো আছেই।
তবুও এর সুফল উল্লেখযোগ্য। সনদপ্রাপ্ত ইয়ার্ডগুলো জাহাজপ্রতি বেশি দাম আদায় করতে পারে, আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় এবং উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র রক্ষায়ও অবদান রাখতে। পারে।
এদিকে বৈশ্বিক জাহাজ ভাঙা বা শিপ ব্রেকিং বাজারে বাংলাদেশের পরেই রয়েছে ভারত ও তুরস্ক। ২০২৪ সালে ভারত ২ দশমিক ১৫ মিলিয়ন এবং তুরস্ক ০ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন গ্রস টন জাহাজ পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেল করেছে। এই তিন দেশ মিলে বিশ্বব্যাপী মোট জাহাজ পুনর্ব্যবহার বাজারের ৮৪ শতাংশ দখল করে রেখেছে।
বিশ্বে জাহাজভাঙা শিল্পে মন্দা
বিশ্বব্যাপী জাহাজ পুনর্ব্যবহারের পরিমাণ ২০২৪ সালে নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন গ্রস টনে—যা আগের বছরের (২০২৩) ৭ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন টনের তুলনায় ১৫ দশমিক ২ শতাংশ কম।
আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাজ পুনর্ব্যবহারের এই পতন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—শক্তিশালী বাজার আয় (যখন জাহাজ মালিকেরা মুনাফা বাড়াতে পুরোনো জাহাজও সচল রাখেন), নতুন জাহাজ নির্মাণ ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি এবং কিছুক্ষেত্রে জাহাজ রিসাইক্লিং সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা।
তবে আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে আশার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্বল্পমেয়াদে জাহাজ পুনর্ব্যবহার নিম্নমুখী থাকবে, তবে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, সেকেন্ডহ্যান্ড জাহাজের দাম কমলে, 'শ্যাডো ফ্লিট'-এ কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পেলে এবং পুরোনো বহরের আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত হলে এর পুনরুদ্ধার ঘটবে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বহর ডেলিভারির পরিমাণ বেশি এবং বহর দ্রুত পুরোনো হয়ে পড়লেও বিশ্বব্যাপী জাহাজ পুনর্ব্যবহার সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। এটি শুধু যোগান ও চাহিদার ভারসাম্যের জন্য নয়, বরং বহর সময়মতো নবায়নের ক্ষেত্রেও উদ্বেগের কারণ—বিশেষ করে ক্রমশ কঠোর পরিবেশগত বিধিনিষেধের প্রেক্ষাপটে।
এছাড়া বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রধান জাহাজ পুনর্ব্যবহারকারী দেশে সক্ষমতা সীমিত। তার ওপর টেকসই জাহাজ পুনর্ব্যবহারের মানদণ্ড ও কঠোর নিয়মকানুন বাড়তি চাপ তৈরি করছে।