আঞ্চলিক প্রতিযোগীদের দাপটে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প

একসময় বৈশ্বিক জাহাজ ভাঙা শিল্পে বাংলাদেশের আধিপত্য থাকলেও এখন সেই অবস্থান হারাতে বসেছে। উন্নত কমপ্লায়েন্স, ভালো দাম ও দ্রুত কার্যপ্রক্রিয়ার সুবাদে এই বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে নিচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান।
বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের স্ক্র্যাপ জাহাজগুলোর ব্যস্ততম গন্তব্য ছিল চট্টগ্রাম। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে সেই চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। ভারতের আলং ইয়ার্ড নিজেদের সুনাম বাড়াচ্ছে, পাকিস্তানের গাদানি ফের গতি পাচ্ছে, আর মাত্র ১৪টি গ্রিন ইয়ার্ড নিয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে।
এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশে ২৪টি জাহাজ ভাঙার জন্য আনা হয়, যেখানে ভারতে আসে ২১টি ও পাকিস্তানে তিনটি। কিন্তু দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশে এই সংখ্যা কমে ২২টিতে দাঁড়ায়, অথচ ভারত ২১টি জাহাজ নিয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে এবং পাকিস্তানে সংখ্যা বেড়ে চারে দাঁড়ায়।
২৬ জুন হংকং কনভেনশন কার্যকর হওয়ার পর এই মন্দা আরও গভীর হয়।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) তথ্য অনুযায়ী, এরপর থেকে জাহাজ আমদানি তীব্রভাবে কমে গেছে। আগস্টে সীতাকুণ্ডে জাহাজ আমদানির জন্য নতুন কোনো এনওসি দেওয়া হয়নি। জুনে ৯০ হাজার টন ওজনের সাতটি ও জুলাইয়ে ৮০ হাজার টন ওজনের আটটি জাহাজ আনা হয়েছিল।
বিএসবিআরএর সহসভাপতি জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, 'সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা জাহাজ ভাঙা শিল্পকে কৌশলগত খাত হিসেবে দেখে কি না। আমরা যদি গড়িমসি করতে থাকি, তাহলে বাংলাদেশ এমন এক শিল্প হারাবে যা কর্মসংস্থান, ইস্পাত ও বৈশ্বিক পরিচিতি এনে দিচ্ছে।'
এগিয়ে যাচ্ছে ভারত
ভারতে এখন প্রায় ১১০টি কমপ্লায়েন্ট ইয়ার্ড রয়েছে, যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। আলংয়ে কর্তৃপক্ষ তদারকি জোরদার করেছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা জাহাজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে এবং হংকং কনভেনশনের মান অনুযায়ী দ্রুত আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ রেকর্ডের সুবাদে জাহাজ মালিকরা সেখানে জাহাজ পাঠাতে আস্থা পাচ্ছেন।
শিপ ব্রোকাররা বলছেন, দেশেই শক্তিশালী ইস্পাতের বাজার ও স্থিতিশীল মুদ্রার কারণেও ভারত সুবিধা পাচ্ছে। এতে তারা বেশি দাম দিতে পারছে।
গ্লোবাল শিপ ব্রোকার জিএমএস ইনক-এর স্থানীয় প্রতিনিধি তৌফিকুল ইসলাম বলেন, 'কমপ্লায়েন্স খাতে আগে বিনিয়োগ করার সুফল ভারত এখন স্পষ্টভাবে পাচ্ছে। বাজারে ধারণা তৈরি হয়েছে যে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। দামের চেয়েও বড় বিষয় হলো এই ধারণাটাই এখানকার ব্যবসার ক্ষতি করছে।'
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পাকিস্তান
কয়েক বছরের মন্দার পর পাকিস্তানের গাদানি ইয়ার্ড ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখাচ্ছে। ইয়ার্ডটি এখনও পুরোপুরি কমপ্লায়েন্ট না হলেও সাময়িক সুরক্ষা সনদ ইস্যু করেছে, পেয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও। সম্প্রতি গাদানি মাত্র এক সপ্তাহে ১৬ হাজার টনের বেশি ওজনের চারটি জাহাজ পেয়েছে।
তৌফিকুল ইসলাম বলেন, 'গাদানির এই উত্থান প্রমাণ করে যে বাজার শুধু কমপ্লায়েন্সকেই পুরস্কৃত করে না, বরং গতিশীলতাকেও স্বীকৃতি দেয়।'
বাংলাদেশের গতিমন্থরতা আরও বেড়েছে
বাংলাদেশে রি-রোল্ড স্টিলের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমছে, ইনভেন্টরি বাড়ছে এবং সস্তা আমদানি পণ্যের কারণে দাম কমে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ৪১৭ ডলারে নেমে আসে, যা আগের সপ্তাহের চেয়ে প্রায় ১০ ডলার কম।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলেন, জাহাজ সৈকতে আনার পর তা ভাঙার চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে প্রায় দুই মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশি ইয়ার্ডগুলোর চেয়ে ভারত ও পাকিস্তান প্রতি টনে ১৫-২০ ডলার বেশি দাম দিচ্ছে।
সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্পের ব্যবসায়ী নূর উদ্দিন রুবেল বলেন, 'অর্থায়ন ও কমপ্লায়েন্স—দুই ক্ষেত্রেই আমরা বেশি খরচ করছি, কিন্তু দাম পাচ্ছি কম। বেশি গ্রিন ইয়ার্ড নিয়ে ভারত ভালো দাম দিচ্ছে, আর পাকিস্তান সস্তায় কাজ করছে। আমরা মাঝখানে আটকে পড়েছি।'
তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি জাহাজের জন্য প্রতি টনে ৬৫০ ডলার দর দেওয়া হলেও একটি ভারতীয় ইয়ার্ড ৬৮০ ডলার দাম দিয়ে সেটি কিনে নেয়, যা বাংলাদেশি ইয়ার্ডগুলোর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না।
নীতিনির্ধারণী জটিলতা ও মানবিক সংকট
গত বছর বাংলাদেশ হংকং কনভেনশনে অনুসমর্থন দিলেও এর অগ্রগতি বেশ ধীর। বেশ কিছু ইয়ার্ড এখনও ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আছে বা অর্থায়নের সমস্যায় আটকে আছে। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতিগত দীর্ঘসূত্রতার কারণে নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
এই মন্দা সরাসরি কর্মীদের জীবনকে সংকটে ফেলছে। চট্টগ্রাম ও সীতাকুণ্ডের ইয়ার্ডগুলোতে প্রায় ২০ হাজার কর্মী সরাসরি নিযুক্ত, আরও দুই লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে যুক্ত। তাদের অনেকেই এখন নিয়মিত কাজ পান না, বেতন পেতে দেরি হয়, কিংবা ছাঁটাইয়ের শিকারও হচ্ছেন।
শিপব্রেকিং ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের ফজলুল কবির মিন্টু বলেন, 'শ্রমিকরা এরইমধ্যে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন।'
১২ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ইয়ার্ড কর্মী জিল্লুর রহমান বলেন, ২০২৪ সাল থেকে তার আয় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। 'আগে আমরা ওভারটাইম করে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারতাম। এখন জাহাজও কম, বেতনও অনিয়মিত হয়ে গেছে।'