দ্বিগুণ দায়িত্ব, সীমিত স্বাধীনতা: কর্মক্ষেত্র ও সংসারে চাপের মুখে নারী পোশাক শ্রমিকরা

আশুলিয়ার ডিইপিজেড এলাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন শাহীনা। একই কারখানায় কাজ করেন তার স্বামী মো. আমিনুর রহমানও। দুজনের কর্মস্থল, কাজের সময় ও আয় সমান হলেও পার্থক্যটা তৈরি হয় সংসারের ভেতরে। শাহীনা প্রতিদিন গৃহস্থালীর দ্বিগুণ দায়িত্ব পালন করেন, আর আমিনুর বাসায় ফিরেই সময় নেন নিজের জন্য।
সারাদিন কারখানায় কঠোর পরিশ্রমের পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফেরেন শাহীনা পারভীন। কিন্তু সেখানেও তার বিশ্রামের সুযোগ নেই। রান্না, সন্তানের পড়াশোনা দেখা, কাপড় ধোয়া—সব দায়িত্ব কাঁধে নেন তিনি একাই।
'সংসারের কাজ আমাদেরই (নারী) করতে হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকে তো এটাই দেখে বড় হয়েছি,' ক্লান্ত শরীরে রান্না করতে করতে বলেন শাহীনা।
তিনি হাসতে হাসতে আরও বলেন, 'আসলে আমাদের দুটি চাকরি করতে হয়—একটা কারখানায়, আরেকটা বাসায়।'
সীমিত আর্থিক স্বাধীনতা
শুধু সংসারের দায়িত্ব নয়, নিজের উপার্জিত অর্থেও পুরো অধিকার নেই অনেক নারী শ্রমিকের। শ্রীপুরে বসবাসরত লাবন্য আক্তার দীপা বা সাভারের হেমায়েতপুরের আজমিরা খাতুনের মতো অনেকেই বেতন হাতে পাওয়ার পরপরই তা তুলে দেন স্বামীর হাতে।
লাবন্য বলেন, 'আমাদের মেয়েদেরও শখ-আহ্লাদ থাকে। কিন্তু মাস শেষে সব টাকা তার (স্বামী) হাতে তুলে দিতে হয়। নিজের জন্য কিছুই থাকে না।'
তিনি জানান, প্রেগনেন্সির কারণে চাকরি বন্ধ থাকার সময় শিশুর দুধ কেনার টাকাও পাননি স্বামীর কাছ থেকে। বাধ্য হয়ে আবার নতুন করে চাকরিতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আজমিরা খাতুনও একই অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, 'কখনো ১০ টাকার খাবার খেতে ইচ্ছে হলেও স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। তার ইচ্ছে হলে দেয়, না হলে না।'
সামাজিক মানসিকতা ও নারীর ওপর দ্বিগুণ চাপ
অধিকারকর্মীরা বলছেন, পরিবারে গৃহস্থালীর কাজ কেবল নারীর দায়িত্ব—এই মানসিকতা এখনও সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীর আয়ের উপর সীমিত অধিকার।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, 'গৃহস্থালীর কাজ একমাত্র নারীর—এটা পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক কাঠামোর মানসিকতা। এই নর্ম ভাঙতে হলে মানসিকতার পাশাপাশি চিন্তার গভীরতার পরিবর্তন প্রয়োজন। সমাজে নারীদের পিছিয়ে থাকার পেছনে কালেক্টিভ উইলিংনেসের অভাব রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'নিজের উপার্জিত অর্থে নারীর অধিকার সীমিত করে রাখা আসলে নারীকে সিস্টেমেটিক্যালি এমপাওয়ার্ড হতে না দেওয়ার প্রতিফলন।'

তিনি বলেন, 'উন্নত অনেক দেশে যেখানে সিঙ্গেল মাদারকে রাষ্ট্র ভাতা দেয়, সেখানে আমাদের দেশে একজন বিধবাকে ভাতা দেওয়া হলেও সিঙ্গেল মাদারকে দেওয়া হয় না। রাষ্ট্র আসলে ওইভাবে চিন্তা করেনা।'
এশিয়া ফ্লোর ওয়েজ এলায়েন্স-এর জেন্ডার জাস্টিস প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর (বাংলাদেশ) আমরিন হোসেন এ্যানি বলেন, 'এই মানসিকতা নারী শ্রমিকদের উপর শুধু দ্বিগুণ চাপ তৈরি করছে না, একই সাথে এই শিল্পে নারী নেতৃত্ব তৈরির পথেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
তিনি নারীর উপার্জিত অর্থে পূর্ণ অধিকার না থাকার বিষয়টিকে 'অর্থনৈতিক নির্যাতন' হিসেবে উল্লেখ করেন। তার মতে, নারীরা সংসারে অশান্তির ভয়ে চুপচাপ তা মেনে নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের সমাজের নারীরাও আসলে মনস্তাত্ত্বিকভাবেই এটি মেনে নিয়েছে এবং এর শুরুটা হয় পরিবার থেকেই। এছাড়াও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও এই মানসিকতাকে ধারণ করছে। বাংলাদেশের নারী-পুরুষ এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা পুরুষের হাতেই রয়ে গেছে।'
পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু মনে করেন, নারী-পুরুষের মধ্যকার এই বিভেদ নিয়ে আমাদের সামাজিক নর্ম একদিনে পরিবর্তন হবে না। তবে পরিবার, শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগ নিলে ধীরে ধীরে পরিবর্তন সম্ভব।
এ বিষয়ে অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, 'নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নারীর সম্পদ অর্জন ও মালিকানার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিছু সুবিধা ইনট্রোডিউস করলে সেটিও সহায়ক হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'নারীকে রিলিজনের সাথে কন্ট্রাডিকটরি অবস্থানে না নিয়ে গিয়ে কিভাবে কালচারাল মোটিভেশন তৈরি করা যায়, সেই বিষয়ে ভাবতে হবে। পাশাপাশি নারী-পুরুষ সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকেও নজর দিতে হবে।'
অধিকারকর্মীরা বলছেন, নারীর জন্য আর্থিক স্বাধীনতা ও সংসারে সমান দায়িত্ব নিশ্চিত না করলে পোশাক খাতে নারীদের উপর চাপ আরও বাড়বে, আর নেতৃত্বের জায়গায়ও তারা পিছিয়ে পড়বে।