ট্রাম্পের শুল্কে ম্লান হতে পারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অর্জন
এ বছরটা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হওয়ারই কথা ছিল। গত বছর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে দেশটি। এরপর গণ-আন্দোলনের মুখে এক স্বৈরশাসকের পতন ঘটে এবং দেশ চলে যায় বিশৃঙ্খলার দ্বারপ্রান্তে।
এরপর যখন নতুন অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি সামলাতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিল, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়—যা ছিল দেশের জন্য এক নতুন ধাক্কা। অথচ এ দেশের অর্থনীতি অনেকটাই টিকে আছে রপ্তানি আয়ের ওপর—যার মাধ্যমে আমদানি করা হয় জ্বালানি, খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।
তবে বিশ্বব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাময়িকভাবে সেই শুল্ক স্থগিত করেন। তবে আবার তা চালু হওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কে রয়েছেন দেশের লাখ লাখ পোশাকশ্রমিক, যাদের জীবিকা এই খাতের ওপর নির্ভরশীল।
উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসা মুরশিদা গত পাঁচ বছর ধরে সেলাই মেশিনে কাজ করে নিজের পরিবার চালাচ্ছেন। সম্প্রতি ঢাকার কাছে সাভারে অবস্থিত '৪এ ইয়ার্ন ডাইং' নামের একটি পোশাক কারখানায় তিনিসহ আরও ২০০ নারী যোগ দিয়েছেন। কারখানার ৭০ শতাংশ কর্মচারীই নারী।
নতুন কর্মস্থলে তিনি প্রতি মাসে প্রায় ১৮ হাজার টাকা বেতন পাবেন, যা আগের চাকরির তুলনায় কিছুটা বেশি। এছাড়া এখানে যাতায়াতও সহজ, আর পরিবেশও ভালো।
ট্রাম্পের শুল্ক মুরশিদাকেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, 'আমার চিন্তা অর্ডার নিয়ে। যদি অর্ডার কমে যায়, তাহলে তো কাজও কমে যাবে।
প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ, আকারে আমেরিকার উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের সমান। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে প্রায় অবজ্ঞা করা হতো। কিন্তু ১৯৮০ দশক থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর ভর করে দেশটি ঘুরে দাঁড়ায়। আর এই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক, আর তারাই বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম পোশাক উৎপাদনকারী দেশে পরিণত করেছেন।
ফলে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। এমনকি গড় আয় ও জীবনমানের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন পাশের দেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। পরোক্ষভাবে জড়িত আরও কয়েক কোটি। মুরশিদার মতো কর্মীদের ওপরই নির্ভর করে স্বামী-সন্তানসহ তাদের পরিবার।
কিন্তু ট্রাম্প যেভাবে নতুন শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করেছেন—যার সঙ্গে চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্কের মতো প্রভাব যুক্ত হলে—বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি গার্মেন্ট খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্ক আরোপ স্থগিত করার আগে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস তাকে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি ৯০ দিনের জন্য শুল্ক থেকে অব্যাহতির অনুরোধ করেন। ইউনূস প্রতিশ্রুতি দেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি তুলা ও অন্যান্য পণ্য কিনবে—যাতে দেশটির ৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কিছুটা হ্রাস পায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর এই শুল্ক হুমকিকে 'ক্ষমতার কুৎসিত প্রদর্শন' বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই হুমকি এমন সময়ে এসেছে, যখন বাংলাদেশ কয়েক দশকের ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির পর মন্দার মুখে পড়েছে এবং অর্থনৈতিকভাবে বেশ দুর্বল।
টানা ১৫ বছর শক্ত হাতে দেশ শাসন করা হাসিনা সরকারকে দুর্বল করে দেয় ২০২৪ সালের মুদ্রা সংকট। তার পতনের পর তৈরি হয় এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা। নয় মাস পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনো গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেখাতে পারেনি।
বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে, যার সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র।
এমনকি ট্রাম্প যদি জুলাইয়ে ঘোষিত শুল্ক মওকুফের মেয়াদ শেষে ৩৭ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহাল না-ও করেন, তারপরও বাংলাদেশকে ১০ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়তে হবে—যেটি তিনি প্রায় সব দেশের পণ্যের ওপরই আরোপ করেছেন।
পোশাক খাতে লাভের হার কম হওয়ায় ১০ শতাংশ শুল্কও বাংলাদেশকে ভোগাবে। এই খাতে প্রতিযোগিতা অনেক—বিশ্বে বাংলাদেশ থেকে বেশি পোশাক রপ্তানি করে শুধু চীন। পাশাপাশি ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোও বাংলাদেশের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রপন্থীরা আশার প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। তবে শেখ হাসিনার সঙ্গে গড়ে তোলা জোট হারিয়ে ভারত অনেকটা নাখোশ হয়েছে বলা চলে। অন্যদিকে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ড. ইউনূসকে স্বাগত জানিয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক খাত থেকে যে লুটপাট হয়েছে, তার প্রভাব সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা ধারণা করেছিল, ২০২৫ সালটা প্রবৃদ্ধি কম হলেও ২০২৬ সাল নাগাদ ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ সেই আশায় জল ঢেলে দেয়। বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে আগামী দুই বছরের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে।
এছাড়া, গত বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণও মাথার ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো ও দাম বাড়ানোর জন্য আমরা আইএমএফ-এর প্রচণ্ড চাপে রয়েছি।'
১০ শতাংশ শুল্ক এবং ভবিষ্যতে আরও শুল্ক আরোপের আশঙ্কা বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের জন্য বড় ধরনের আঘাত। তবে সময়ের পরিক্রমায় এই খাত নিজেকে আমূল বদলেছে।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা নামে একটি বিশাল গার্মেন্ট কারখানা ধসে পড়ে, যাতে এক হাজার ১০০–র বেশি শ্রমিক নিহত হন। এই মর্মান্তিক ঘটনা বিদেশি ক্রেতাদের—বিশেষ করে পশ্চিমা বড় পোশাক ব্র্যান্ডগুলোকে—বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের ওপর আস্থা হারাতে বাধ্য করে।
তবে শিল্প খাতটি টিকে থাকার জন্য পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বুঝে ঘুরে দাঁড়ায়। এখনো ঢাকা থেকে সাভারে প্রবেশমুখে রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষের জায়গাটি খালি পড়ে আছে। আর সেখানকার ভয়াবহতা ও বাস্তবতা থেকে নেয়া শিক্ষাই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও শিল্প উৎপাদনের ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এখন আগের চেয়েও সংগঠিত। কারখানার সংখ্যা কমলেও রপ্তানির পরিমাণ ও কর্মসংখ্যা উভয়ই বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৩০টি গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে যেগুলো 'লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (এলইইডি)' নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রত্যয়নপ্রাপ্ত। এ সংখ্যা বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি।
এই তালিকায় মুরশিদা আক্তারের কর্মস্থল সাভারের ৪এ ইয়ার্ন ডাইং কারখানাও রয়েছে। যদিও 'ইয়ার্ন ডাইং' নামেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত, প্রকৃতপক্ষে তারা বহু বছর ধরেই কোনো ধরনের সুতা রঙের কাজ করে না। বরং তারা এখন মূলত উচ্চমূল্যের জ্যাকেটসহ বিদেশে পোশাক রপ্তানি করে। এসব জ্যাকেটে রয়েছে ঝকঝকে চেইন, জলরোধক প্রযুক্তি ও অন্যান্য জটিল উপকরণ।
যদিও ইয়ার্ন ডাইং-এর ইউরোপীয় ক্রেতার সংখ্যাই বেশি, তবে তাদের কারখানার ক্রেতার তালিকায় কারহার্ট ও ক্যালভিন ক্লেইনের মতো বিভিন্ন আমেরিকান ব্র্যান্ডও রয়েছে।

কারখানার পাঁচ তলা জুড়ে কর্মীরা ব্যস্ত—কেউ কাপড় কাটছেন, কেউ সেলাই করছেন, কেউ আবার স্টিচিংয়ে ব্যস্ত। তারা প্রস্তুত করছেন কস্টকোর 'জ্যাকস নিউইয়র্ক' সিরিজের নতুন পোশাক। দেয়ালে লাগানো বিশাল ফ্যানের শব্দে মিলিয়ে চলে সেলাই মেশিন আর সাথে বাজে হালকা সংগীত। কারখানায় আলো বাতাসের কোনো কমতি নেই, এজন্য সাভারের প্রখর গরমেও কাজের জন্য বেশ আরামদায়ক।
কারখানার ভেতরের সাইনবোর্ডগুলো প্রথমে ইংরেজিতে, পরে বাংলায় লেখা—যা দেখলেই বোঝা যায় বিদেশি পরিদর্শকদের জন্যই এমন ব্যবস্থা। দেশের অন্যান্য গার্মেন্টসের মতোই ৪এ ইয়ার্ন ডাইং-ও বিদেশি নিরীক্ষকদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় রয়েছে।
কারখানার বাইরের অংশজুড়ে রয়েছে সবুজ গাছপালার সৌন্দর্য। ছাদজুড়ে বসানো হয়েছে সৌর প্যানেল, যা আংশিকভাবে কারখানার বিদ্যুৎ চাহিদা মেটায়।
গত আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের সময়কার গণবিক্ষোভের মধ্যে এই কারখানাটিও হামলার মুখে পড়ে। তবে কারখানার জেনারেল ম্যানেজার খন্দকার ইমাম গর্বের সঙ্গে বলেন, 'তবু আমাদের কারখানার কাজ বন্ধ হয়নি।'
প্রায় প্রতিটি কারখানার মতোই ৪এ ইয়ার্ন ডাইংয়ের সামনেও জড়ো হয়েছিল বিক্ষুব্ধ জনতা। অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো এই প্রতিষ্ঠানকেও হাসিনা শাসনামলের সহযোগী হিসেবে সন্দেহ করা হয়েছিল। কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার খন্দকার ইমাম বলেন, 'আমাদের কারখানায় প্রায় এক হাজার মানুষ হামলা করতে এসেছিল।' তিনি জানান, তিনি নিজে হেলমেট পরে কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গেটের বাইরে বিক্ষোভকারীদের প্রতিরোধ করেন।
শেষ পর্যন্ত কেউ গুরুতর আহত হননি, এমনকি একদিনের জন্যও উৎপাদন থেমে যায়নি। তার ভাষ্যে, দেশের মতো, এই প্রতিষ্ঠানও সংকট মোকাবিলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
কোম্পানির সাসটেইনেবিলিটি প্রধান মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন বলেন, 'এই দেশের পুরো অর্থনীতি এই খাতের ওপর নির্ভরশীল।' তার মতে, যারা হাসিনার সরকার পতনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারাও এটা বোঝেন। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের একটাই জিনিস দেয়ার আছে, আর সেটা হলো শ্রম।'