চীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ইন্টেলের সিইও’র পদত্যাগ চান ট্রাম্প

চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ককে 'চরম বিরোধপূর্ণ' আখ্যা দিয়ে ইন্টেল সিইও লিপ-বু তানের পদত্যাগ দাবি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
গত বৃহস্পতিবার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে তিনি লেখেন, 'ইন্টেলের সিইও ভীষণ বিরোধপূর্ণ অবস্থানে আছেন। তাকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে। এই সমস্যার আর কোনো সমাধান নেই।'
এর আগের দিন, রিপাবলিকান সিনেটর টম কটন ইন্টেলের বোর্ড চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি পাঠিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তানের সংশ্লিষ্টতা এবং তার পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান ক্যাডেন্স ডিজাইনের একটি অপরাধমূলক মামলার বিষয়ে ব্যাখ্যা চান।
এপ্রিল মাসে রয়টার্স–এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, লিপ-বু টান চীনের শতাধিক উন্নতমানের উৎপাদন ও চিপ নির্মাতা কোম্পানিতে অন্তত ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন। এসব কোম্পানির কয়েকটির সঙ্গে চীনা সামরিক বাহিনীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ট্রাম্পের মন্তব্যের পর বৃহস্পতিবার ইন্টেলের শেয়ারমূল্য তিন শতাংশ কমে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রে নিজস্ব চিপ উৎপাদন জোরদারে সরকারের যে উদ্যোগ চলছে, তাতে ইন্টেল গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি 'চিপস অ্যাক্ট ২০২২'-এর আওতায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকি পেয়েছে—যা এই আইনের অধীনে সবচেয়ে বড় সহায়তা। এতে ওহাইয়োসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নতুন কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে নেতৃত্ব পরিবর্তনের আলোচনা কোম্পানিটির ওপর চাপ আরও বাড়াতে পারে।
এদিকে, এক বিবৃতিতে লিপ-বু তান জানিয়েছেন, জাতীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রশ্নে তিনি প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, 'আমার সুনাম গড়ে উঠেছে বিশ্বাসের ভিত্তিতে—আমি যা বলি, তা করি এবং সঠিকভাবে করি। ইন্টেলের নেতৃত্বেও সেই মূল্যবোধ অনুসরণ করছি।'
তিনি আরও জানান, কোম্পানির রূপান্তর পরিকল্পনা ও উন্নতমানের চিপ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বোর্ডের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে এবং সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ট্রাম্পের এই প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিরল ঘটনা। কোনো প্রেসিডেন্ট সরাসরি কোনো সিইও-র পদত্যাগ দাবি করায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
ল্যাডেনবার্গ থালম্যান অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সিইও ফিল ব্লাঙ্কাতো বলেন, 'এটি একটি দুঃখজনক নজির স্থাপন করবে। আপনি নিশ্চয়ই চান না, একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঠিক করে দেবেন কে কোন কোম্পানি চালাবে। তবে ট্রাম্পের মতের অবশ্যই গুরুত্ব আছে।'
ইন্টেলের শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান অ্যাপটাস ক্যাপিটাল অ্যাডভাইজরস-এর ইক্যুইটি প্রধান ও পোর্টফোলিও ম্যানেজার ডেভিড ওয়াগনার বলেন, 'অনেক বিনিয়োগকারীই হয়তো মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খুব বেশি কিছুতে হস্তক্ষেপ করছেন। তবে এটি আরও একটি ইঙ্গিত যে তিনি ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সত্যিই খুব সিরিয়াস।'
এদিকে, ইন্টেল জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা সম্প্রসারণে 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'আমরা প্রশাসনের সঙ্গে চলমান যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে আগ্রহী।'
রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, লিপ-বু তান তার ভেঞ্চার ফান্ডগুলোর মাধ্যমে ২০১২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন। এসবের মধ্যে কিছু কোম্পানি চীনা সেনাবাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মির ঠিকাদার ও সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করেছে।
প্রতিবেদনটি চীনের ব্যবসায়িক ডেটাবেইস বিশ্লেষণ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সূত্রে থাকা সামরিক সংশ্লিষ্ট কোম্পানির তালনার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত এক সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছিল, লিপ-বু তান চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজের বিনিয়োগ থেকে সরে এসেছেন। তবে এই বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য তখন দেওয়া হয়নি।
তবে রয়টার্সের বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেই সময় চীনা ডেটাবেইসে টানের অনেক বিনিয়োগ 'চলমান' হিসেবে দেখানো হচ্ছিল। ফলে ঠিক কী পরিমাণ বিনিয়োগ তিনি প্রত্যাহার করেছেন, তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
মালয়েশিয়ায় জন্ম নেওয়া চীনা বংশোদ্ভূত এই মার্কিন নাগরিক ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাডেন্স ডিজাইনের সিইও ছিলেন। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটি একটি চীনা সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার বিক্রি করে, যা পরমাণু বিস্ফোরণের সিমুলেশন কার্যক্রমে যুক্ত ছিল বলে ধারণা করা হয়।
গত মাসে ক্যাডেন্স অভিযোগ স্বীকার করে নেয় এবং ১৪০ মিলিয়ন ডলারের বেশি জরিমানা দিতে রাজি হয়।
বার্নস্টেইনের বিশ্লেষক স্টেসি রাসগন বলেন, 'আমরা মনে করি না লিপ-বু তান 'বিরোধপূর্ণ' অবস্থানে আছেন। তবে বর্তমান প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।'
তিনি আরও বলেন, 'দুঃখজনকভাবে, অন্যান্য টেক সিইওদের মতো ট্রাম্পের সঙ্গে লিপ-বু টানের ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, যা হয়তো প্রেসিডেন্টের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত করতে পারত।'
সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ কোম্পানি হিসেবে একসময় আধিপত্য বিস্তারকারী ইন্টেল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উৎপাদনে পিছিয়ে পড়েছে তাইওয়ানের টিএসএমসির কাছে। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চিপ বাজারে এনভিডিয়া বড় সাফল্য পেলেও ইন্টেলের অবস্থান দুর্বল। এমনকি ডেটা সেন্টার ও পার্সোনাল কম্পিউটারের বাজারেও প্রতিষ্ঠানটি এএমডির কাছে হার মানছে।
গত বছর ইন্টেল তাদের সিইও প্যাট গেলসিঙ্গারকে বরখাস্ত করে। চার বছরের একটি রোডম্যাপ তৈরি করলেও উৎপাদন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ঘোষিত লক্ষ্যে তিনি ব্যর্থ হন বলে রয়টার্স জানায়। এরপর কোম্পানির নেতৃত্বে আসেন বোর্ড সদস্য লিপ-বু তান।
চিপশিল্পে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও স্টার্টআপে বিনিয়োগ সাফল্যের কারণে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি আগের রোডম্যাপ থেকে সরে আসেন, ব্যাপক ছাঁটাই শুরু করেন এবং বিভিন্ন দেশে কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা স্থগিত করেন।
রয়টার্স জানায়, ইন্টেলের উচ্চমানের ও লাভজনক চিপ তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুণগত মান নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ওহাইয়োতে নির্মাণাধীন একটি কারখানার কাজ ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এটি ২০৩০ বা ২০৩১ সালের দিকে সম্পন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।