পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে ফাঁকি, রাশিয়ার বোমা কারখানা যেভাবে কিনেছে সিমেন্সের প্রযুক্তি

ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যখন রাশিয়া সামরিক উৎপাদন বাড়াতে মরিয়া, তখন দেশটির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিস্ফোরক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান চীনা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে জার্মানি-ভিত্তিক বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সিমেন্স- এর তৈরি যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে সফলভাবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে এড়িয়ে গেছে।
এভাবেই সিমেন্সের উন্নত মেশিন সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে রাশিয়ার বিয়স্ক ওলিয়াম কারখানায় (বিওজেড)। এই কারখানা ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার বোমা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাইবেরিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত বিয়স্ক ওলিয়াম ফ্যাক্টরির (বিওজেড) মেশিন স্বয়ংক্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয় সিমেন্স যন্ত্রপাতি একটি রুশ মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান টেকপ্রিবর -এর মাধ্যমে কেনা হয়, যারা চীনের পাইকারি প্রযুক্তি বিক্রেতাদের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে থাকে। বার্তাসংস্থা রয়টার্সের পর্যালোচিত কাস্টমস তথ্য ও সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত নথিতে থেকে যা জানা গেছে।
চীনের হইঝৌ ফান টেক ও নিউ সোর্স অটোমেশন কোম্পানি লিমিটেড -এর মাধ্যমে সিমেন্সের স্বয়ংক্রিয় শিল্প উপকরণ আমদানি করা হয়। কাস্টমসের তথ্য ও সরকারি ক্রয় নথিতে যেসব কার্ট কোড ও বর্ণনা দেয়া ছিল, সেসব মেলানোর পর সিমেন্সের নির্দিষ্ট মডেলের 'পাওয়ার রেগুলেটর' পাওয়া গেছে— যা বিওজেড অর্ডার করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মস্কোকে শুক্রবারের মধ্যে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত না হলে নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু, রাশিয়ার সামরিক শিল্পখাত যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে পারছে, এই ঘটনা সেটিই সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরছে।
রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহায়তার অভিযোগে, বিওজেড-এর মূল কোম্পানি ফেডারেল স্টেট এন্টারপ্রাইজ ইয়াএম স্ভের্দলোভ প্ল্যান্ট ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে।
নথি অনুসারে, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে বিওজেড সিমেন্সের যন্ত্রপাতি কিনতে টেকপ্রিবরের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ১৪০ দিনের মধ্যে সরবরাহ সম্পন্নের সময়সীমার আগেই, চীনের গুয়াংডং প্রদেশভিত্তিক শিল্প যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী হইঝৌ ফান টেক থেকে টেকপ্রিবর একটি চালান গ্রহণ করে।
সিমেন্সের পণ্যের কোড ও কাস্টমস তথ্য মিলিয়ে এবং নথির বর্ণনা বিশ্লেষণ করে রয়টার্স নিশ্চিত করে যে হইঝৌ ফান টেক সরবরাহকৃত দুটি সিমেন্স পাওয়ার রেগুলেটরই বিওজেড-এর অর্ডার করা মডেলের সঙ্গে মিলে গেছে।
রয়টার্স এমন কোনো প্রমাণ পায়নি যে সিমেন্স জানত তার যন্ত্রপাতি একটি রুশ বিস্ফোরক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কিনছে।
সিমেন্সের এক মুখপাত্র জানান, প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে অনুসরণ করে এবং তাদের গ্রাহকদের কাছেও একই প্রত্যাশা রাখে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে কিছু যন্ত্রপাতি তাদের অজান্তেই রাশিয়ায় পৌঁছাতে পারে।
টেকপ্রিবর রয়টার্সের প্রশ্নের জবাব দেয়নি, বিওজেড এবং তার মূল কোম্পানির পক্ষ থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
যদিও আগে থেকেই জানা যে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প চীন থেকে পশ্চিমা প্রযুক্তি সংগ্রহ করে, রয়টার্স এবার সেই প্রযুক্তির সুনির্দিষ্ট যাত্রাপথ উন্মোচন করেছে — যা দেখায় কীভাবে রুশ প্রতিরক্ষা সংস্থা অনায়াসে পশ্চিমা যন্ত্রপাতি কিনতে পারে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে বিওজেড কারখানাটি সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে, সম্প্রসারিত হচ্ছে এর উৎপাদন কাজ। রয়টার্সের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেখানে শক্তিশালী বিস্ফোরক- আরডিএক্স উৎপাদনের জন্য নতুন একটি ইউনিট গড়ে তোলা হচ্ছে।
রুশ প্রতিরক্ষা খাতের জন্য স্বয়ংক্রিয় মেশিন টুল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে কম জনবলেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব — বিশেষ করে যখন এই খাত কর্মী সংকটে ভুগছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা– রয়্যাল সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি) এবং ওপেন সোর্স সেন্টারের এক প্রতিবেদনেও এমন চিত্র উঠে এসেছে।
রাশিয়ার নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় মেশিন টুল উৎপাদনের অভিজ্ঞতা সীমিত, ফলে তারা প্রায়শই আমদানির উপর নির্ভর করে।
পোল্যান্ডভিত্তিক সামরিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রোচান-এর পরিচালক কনরাড মুজিকা জানান, রাশিয়ায় পশ্চিমা যন্ত্রপাতির সরবরাহ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছে। তিনি বলেন, "এই হাই-প্রিসিশান মেশিনারিজগুলো ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন, ড্রোন সংযোজন ও ট্যাংক সংস্কারের মতো উন্নত নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য। এগুলো ছাড়া রাশিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং শ্রমবাজারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টিকারী হতো।"