সিলেটে ভূমিকম্পের ঝুঁকি: রং পাল্টে বহাল ১৮ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন

সিলেট নগরের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের পুরনো বিপণিবিতান 'রাজা ম্যানশন'। ২০১৯ সালে একাধিক ভূমিকম্পের পর সিটি করপোরেশনের (সিসিক) জরিপে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সে সময় ভবন ভাঙার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। তবে অভিযান শেষে কয়েকদিন বন্ধ থাকলেও পরে রং পাল্টে আবার খুলে দেওয়া হয় মার্কেটটি।
একইভাবে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা জিন্দাবাজারের আরেক বহুতল ভবন 'মিতালী ম্যানশন'-এরও কার্যক্রম চলছে রং পাল্টে।
ছয় বছর আগে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা এসব ভবনের ব্যাপারে এখন নির্বিকার সিসিক। ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেটে ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে এসব ভবন। গত রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) সিলেটে আবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো।
২০১৯ সালে একাধিক ভূমিকম্পের পর সিসিক নগরের প্রায় ৪২ হাজার বহুতল ভবন পরীক্ষা ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার উদ্যোগ নেয়। তবে অর্থ সংকটে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। পরে বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার ভিত্তিতে ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিসিক।
সেদিনই সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানশন ও রাজা ম্যানশনসহ ৭টি বিপণিবিতানকে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে সংস্কার ছাড়াই নির্ধারিত সময় পর সেগুলো আবার খুলে দেওয়া হয়। এখনো সেসব ভবনে কার্যক্রম চলছে।
তালিকায় থাকা চারটি ভবন ভাঙা হয় এবং দুইটি ভবন সংস্কার করা হয়। কিন্তু ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও বাকি স্থাপনাগুলো নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সিসিক। এগুলোর মধ্যে বাসাবাড়ি, বিদ্যালয় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। অনেকে কেবল রং পাল্টে কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
সিসিকের তালিকা অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে: কালেক্টরেট ভবন-৩, সমবায় ব্যাংক ভবন মার্কেট, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার সাবেক কার্যালয় ভবন, সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মিতালী ম্যানশন, আজমীর হোটেল, মধুবন মার্কেট, মান্নান ভিউ, শুভেচ্ছা-২২৬, ৫১/৩ সরকার ভবন, নবপুষ্প-২৬/এ, রাজা ম্যানশন, কিবরিয়া লজ, মিতালী-৭৪, মেঘনা-এ-৩৯/২, পাঠানটুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ওয়ারিছ মঞ্জিল একতা-৩৭৭/৭, হোসেইন মঞ্জিল একতা-৩৭৭/৮, শাহনাজ রিয়াজ ভিলা একতা-৩৭৭/৯, নূরানী-১৪, পৌর বিপণি ও পৌর শপিং সেন্টার, প্রভাতী-৬২/বি এবং শ্রীধরা হাউস।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, সিলেটে যেকোনো সময় বড় ভূমিকম্প হলে বেশিরভাগ বহুতল ভবন ধসে পড়তে পারে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ও এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমেদ বলেন, 'সিলেটের প্রায় ৪২ হাজার ভবনের অধিকাংশই পুরনো ও দুর্বল। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভবন নির্মাণে নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেই এগুলো ধসে পড়তে পারে।'
তিনি বলেন, 'পুরোপুরি ভূমিকম্প ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে আগে থেকেই কিছু সতর্কতা নিলে ক্ষতি কমানো যাবে।'
সিসিকের সদ্য বিদায়ী প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, 'আমরা ১০টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছিলাম। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংস্কারের নির্দেশ দেওয়া হলেও মালিকরা তা মানেননি। এমনকি ভবন ভাঙতে গেলে আদালতে মামলা করেন।'
এ বিষয়ে সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংস্কারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে একটি কমিটি তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সংস্কারকৃত ভবনের কাগজপত্র যাচাই শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
সিলেট আবহাওয়া অফিস জানায়, গত রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) সিলেটে অনুভূত ভূমিকম্পটির উৎপত্তি ভারতের আসামে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৫.৮। আসামের এ ভূমিকম্পকে সিলেটের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার বলেন, 'বাংলাদেশে দুটি ভূমিকম্প উৎস আছে— উত্তরে ডাউকি ফল্ট এবং পূর্বে হিমালয়ান মেইন ফ্রন্টাল থ্রাস্ট বেল্ট। সর্বশেষ ভূমিকম্পটি ডাউকি ফল্টের কাছাকাছি উৎস থেকে হয়েছে। সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এ অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে শক্তি জমা করছে। যেকোনো সময় ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটতে পারে।'
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অন্তত ৭টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট বিভাগে। এছাড়া গেল দুই বছরে সিলেট ও আশপাশে দেড় শতাধিক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।