ডাকসুর একাল-সেকাল: ৫৪ তে নির্বাচন, ৬০ সালে নারী ভিপি, ৭৩ এ ব্যালট ছিনতাই

দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ছয় বছর পর আবারও ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু প্রথমবার ডাকসু গঠনের সূচনা হয়েছিল কবে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছর পরেই শুরু হয় ছাত্র সংসদ কার্যক্রম। তবে নির্বাচন শুরু হয় আরও পরে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র সাতবার। সর্বশেষটি ২০১৯ সালে, সেটিও আগের নির্বাচনের ২৮ বছর পর! প্রশ্ন থেকে যায়, '৯০-এর সফল নির্বাচনের পর কেন থমকে গিয়েছিল ডাকসু?
ডাকসু ঘিরে যখন ক্যাম্পাসে ও সারাদেশে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে, তখন এর অজানা কিছু ইতিহাস জানা জরুরি হয়ে ওঠে।
ডাসু থেকে ডাকসু
শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ছাত্র কার্যক্রম পরিচালিত হতো আবাসিক হলকে কেন্দ্র করে। ব্রিটিশ সরকার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল অনুসরণ করে এই ব্যবস্থা চালু করে। সেখান থেকেই ছাত্র সংসদের ধারণা আসে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এক প্রবন্ধে লিখেছেন, অক্সফোর্ডের সাবেক শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক স্যার এ. এফ. রহমানের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র সংসদ গঠিত হয়েছিলো। ১৯২১ সালে তিনটি আবাসিক হল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে হলভিত্তিক সংসদ গঠিত হলেও, ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে কেন্দ্রীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর নাম ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট'স ইউনিয়ন (ডাসু)। প্রতিটি হল থেকে তিনজন ছাত্র, একজন শিক্ষক এবং উপাচার্যের মনোনীত আরও একজন শিক্ষককে নিয়ে সংসদ গঠিত হতো। সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন একজন শিক্ষক।
সে সময়ে ছাত্র সংসদ ছিল পুরোপুরি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৩৯ সালে নতুন গঠনতন্ত্রের দাবিতে শিক্ষার্থীরা অনশন করলে প্রশাসন তাদের রচিত গঠনতন্ত্র অনুমোদন করে। তখন থেকে পালাক্রমে এক হল থেকে সভাপতি, অন্য হল থেকে সম্পাদক নির্বাচনের প্রথা শুরু হয়।
১৯৪৪-৪৫ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে উপাচার্যকে সংসদের সভাপতি এবং শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সহ-সভাপতি নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। তবে গণতান্ত্রিক নির্বাচন যুক্ত হয় ১৯৫৩ সালের সংশোধনীতে। একইসঙ্গে সংসদের নাম বদলে রাখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ; ইংরেজি নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে সংক্ষেপে 'ডাকসু'।
প্রথম নির্বাচিত ভিপি বারী, দুইবার ভিপি মান্না
প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট হল থেকে ডাকসু নেতৃবৃন্দ নির্বাচিত করার নিয়ম করা চালু হয় ১৯৫৩ সালের সংশোধনীতে। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে ডাকসুর প্রথম নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের এস. এ. বারী এ.টি, আর সাধারণ সম্পাদক হন জুলমত আলী খান।
১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত হলভিত্তিক চক্রাকার নির্বাচন পদ্ধতি চালু ছিল। এই ব্যবস্থায় সর্বশেষ ভিপি হন তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭০ সালে প্রথমবার সরাসরি ভোটে কেন্দ্রীয় নির্বাচন হয়। তাতে ভিপি হন ছাত্রলীগের আ স ম আব্দুর রব, আর সাধারণ সম্পাদক হন আব্দুল কুদ্দুস মাখন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে ভিপি নির্বাচিত হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। এরপর ছয় বছর বিরতির পর ১৯৭৯ সালে নির্বাচনে জয়ী হন জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না। পরের নির্বাচনে আবারও ভিপি হন তিনি। সে হিসেবে ডাকসুর একমাত্র দুইবার নির্বাচিত ভিপি তিনি। পরের বছর ভিপি হন আখতারুজ্জামান, যিনি এর আগে টানা দুইবার জিএস ছিলেন। এরপর আবারও ৬ বছরের বিরতি!

১৯৮৯-৯০ সালে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ভিপি হন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। ১৯৯০ সালে পূর্ণাঙ্গ প্যানেলে জিতে নেতৃত্বে আসে ছাত্রদল, ভিপি হন আমানউল্লাহ আমান এবং জিএস খায়রুল কবীর খোকন। এরপর টানা ২৮ বছর নির্বাচন বন্ধ থাকার পর ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন নুরুল হক নূর।
১৯৭৩ সালের ব্যালট বাক্স ছিনতাই
ডাকসুর ইতিহাসে আলোচিত ঘটনার একটি ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই। এর আগেই ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সিরাজুল আলম খানের অনুসারীরা আলাদা হয়ে নতুন শক্তি তৈরি করেন। এটি মূল দল থেকে আলাদা হলেও জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক।
আর ছাত্রলীগের এই দুই পক্ষের কোন্দলে ৭২ এর নির্বাচনে চারটি সদস্য পদ ছাড়া সবগুলোতে জিতে নিয়েছিলো ছাত্র ইউনিয়ন। পরের নির্বাচনের দিন ধার্য হয় ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। এই নির্বাচনে ভিপি প্রার্থী ছিলেন নূহ-উল-আলম লেনিন এবং সাধারণ সম্পাদক ইসমত কাদির গামা। অপরদিকে জাসদ–ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জহুর হোসেন।
ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদের বর্ণনা অনুযায়ী, ভোট গণনায় জাসদ-ছাত্রলীগের প্রার্থী মাহবুব–জহুর পরিষদ এগিয়ে থাকায় রাতেই লেনিন–গামার সমর্থকেরা হামলা চালিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে। রোকেয়া হলসহ বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালানো হয়, ভাঙচুর-লুটপাট করা হয় জাসদপন্থী ছাত্রদের কক্ষ। এতে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যান।
নারী নেতৃত্ব
ড. মোহাম্মদ হান্নান রচিত 'বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (১৯৭২ থেকে ২০০০)' গ্রন্থমতে, এখন পর্যন্ত ডাকসুর ইতিহাসে দুইজন নারী ভিপির নাম পাওয়া যায়। ১৯৬০-৬১ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের জাহানারা আকতার প্রথম নারী ভিপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে ভিপি হন ছাত্র ইউনিয়নের আরেক নেত্রী মাহফুজা খানম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার কথা থাকলেও তাকে পাসপোর্ট দেয় নি পাকিস্তান সরকার। তিনি পরবর্তীতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হন। চলতি বছর মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি।
অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হিসেবে এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী ছিলেন মতিয়া চৌধুরি। ১৯৬৩-৬৪ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে জিএস নির্বাচিত হন। সাহসী ভূমিকার জন্য তাকে 'অগ্নিকন্যা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
৯০-এর পর দীর্ঘ বিরতি
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শান্তিপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল জয়ী হয়। কিন্তু এরপর প্রশাসন নানা অজুহাতে নির্বাচন স্থগিত করতে থাকে।
কখনো বলা হয়েছে পরিবেশ অনুকূল নয়, কখনো আবার প্রশাসনিক জটিলতার কারণ দেখানো হয়েছে। একাধিকবার তারিখ ঠিক হলেও শেষ মুহূর্তে বাতিল হয় নির্বাচন। হাইকোর্ট ২০১২ সালে প্রশ্ন তোলে কেন এতদিন নির্বাচন হচ্ছে না। ২০১৮ সালে আদালতের নির্দেশের পর অবশেষে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ বহু প্রতীক্ষিত নির্বাচন সম্পন্ন হয়।
এই দীর্ঘ বিরতি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ কেড়ে নেয়। শিক্ষার্থীদের মতে, দেশের 'দ্বিতীয় সংসদ' হিসেবে খ্যাত ডাকসুকে শাসকগোষ্ঠী সবসময় ভয় হিসেবে দেখেছিল বলেই নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছিল।

ডাকসু ভিপিদের পথচলা
ডাকসুকে বলা হয় নেতা তৈরির সূতিকাগার। ডাকসু নেতৃত্ব পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
ডাকসুর প্রথম নির্বাচিত ভিপি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এস. এ. বারী এ.টি। মুজিববাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে হয়েছিলেন ন্যাপ (ভাসানী) এর সাধারণ সম্পাদক, ছিলেন জিয়াউর রহমান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী। ১৯৮৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
১৯৬৩-৬৪ সালের ভিপি রাশেদ খান মেনন পরবর্তীতে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি হন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
১৯৬৮-৬৯ সালের ভিপি তোফায়েল আহমেদকে বলা হয় '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক'। আওয়ামী লীগ সরকারে তিনিও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের দ্বায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭০-৭১ সালের ভিপি আ স ম আব্দুর রব সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তিনি একাধিকবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, ছিলেন আওয়ামীলীগ সরকারের মন্ত্রী। বর্তমানে তিনি জেএসডির সভাপতি।
স্বাধীনতার পর প্রথম ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছিলেন সিপিবির সভাপতি। দুইবারের ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এখন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি। ১৯৮৯-৯০ সালের ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯০ সালের ভিপি আমান উল্লাহ আমান বিএনপির শীর্ষ নেতা। তিনি একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নূর বর্তমানে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।