সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তার রোডম্যাপ তৈরি করছে সরকার: পরিকল্পনা উপদেষ্টা

অন্তর্বতী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তার একটি রোডম্যাপ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। আগামীতে নির্বাচিত সরকার এ রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করবে।
"বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে, তাই সার্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করার কোনো অজুহাত নেই," তিনি বলেন।
গতকাল সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আয়োজিত তিন দিনের 'ন্যাশনাল কনফারেন্স অন সোশ্যাল প্রোটেকশন ২০২৫'-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
রাজধানীর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, "ন্যায়ভিত্তিক সমাজে চরম দারিদ্র্য থাকতে পারে না। এজন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দারিদ্র্য দূর করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। গত ১৫ বছরে ক্রোনিক ক্যাপিটালাইজেশন ও রাজনৈতিক রেন্ট সিকিংয়ের কারণে আয় বৈষম্য বেড়েছে। এখন সবার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।"
তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে মানুষ দরিদ্র হয়—কেউ পর্যাপ্ত আয় করতে না পারায়, কেউ আয়ের সুযোগ না পেয়ে বা কেউ অসুস্থতার কারণে। ইতোমধ্যে সরকার সামাজিক নিরাপত্তার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতা, ওভারল্যাপিং, অতিরিক্ত প্রশাসনিক ব্যয় ও দুর্নীতির কারণে অনেক প্রকল্প সঠিকভাবে কাজ করেনি। মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী একটি সমন্বিত কর্মসূচি প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, "সুবিধাভোগী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম হয়েছে। বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তার ৫০ শতাংশ সুবিধাভোগী এ সুবিধা পাওয়ার উপযুক্ত নন। এদের আমি 'ভুতুড়ে বা রাজনৈতিক সুবিধাভোগী' বলি। সঠিক সুবিধাভোগী চিহ্নিত করতে ভালো স্থানীয় সরকার দরকার। পাশাপাশি একটি কার্যকর স্ক্রিনিং সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে।"
"জাতীয়ভাবে সমন্বিত তালিকা তৈরি ও মাঠপর্যায় তদারকি করা গেলে প্রকৃত উপকারভোগীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও গত বছরের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম বড় দাবি ছিল সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়া। সবার আয় সমান নাও হতে পারে, কিন্তু সুযোগ সমান থাকতে হবে," যোগ করেন তিনি।
উপদেষ্টা আরও জানান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় কিছু সুবিধা থাকলেও ন্যূনতম জীবনধারণের ব্যবস্থা নিশ্চিত না হলে তা দুঃস্থ মানুষের কাছে কোনো মূল্য বহন করে না। এজন্য সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বাঁচার জন্য ন্যূনতম যা দরকার, তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশে এখন নতুন দারিদ্র্য-পকেট তৈরি হয়েছে। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালীতে এসব দারিদ্র্য-পকেট দেখা যাচ্ছে। এজন্য পরিবারভিত্তিক সুবিধাভোগী চিহ্নিত করার পাশাপাশি আঞ্চলিক ব্যবস্থাও চালু করতে হবে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক) বলেন, "ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ দারিদ্র্য কমানো। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির দুর্বলতা কমাতে সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা জরুরি।"
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য মনজুর হোসেন বলেন, "গত এক দশকে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ। কিন্তু কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। অর্থাৎ কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর পেছনে কারণ ছিল সুশাসনের অভাব, আর্থিক খাতে অনিয়ম, প্রতিষ্ঠান দুর্বল করা এবং ন্যায়বিচার না থাকা।"
তিনি আরও বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বর্তমান বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে শুধু কর রাজস্ব নয়, বন্ড ও বিমার মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে রাজস্ব বাড়ানোর দিকেও নজর দিতে হবে।
মিসিং মিডলের জন্য নীতি দরকার
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে অতিরিক্ত সচিব মো. খালেদ হাসান বলেন, বাংলাদেশে এক শ্রেণির পরিবার আছে যারা 'মিসিং মিডল'। তারা টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে পারে না, আবার সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাভোগীও নয়। কিন্তু পরিবারের ব্যয় মেটাতে সংগ্রাম করতে হয়। এই জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রয়োজন।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, "বাংলাদেশের মানুষ ব্যয়ের দিক থেকে যতটা দরিদ্র, আয়ের দিক থেকে তার চেয়েও বেশি দরিদ্র। অনেককে টিকে থাকার জন্য ঋণ করতে হয়। অনেক পরিবার আছে যারা দরিদ্রসীমার ঠিক ওপরে অবস্থান করছে। তাদের অবস্থা টেকসই নয়, সামান্য ধাক্কায় তারা আবার দরিদ্র হয়ে যেতে পারেন। এরা 'মিসিং মিডল'। এদের জন্য সহায়তার উদ্যোগ দরকার।"
তিনি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, "ধরুন একজন মানুষ নাক বরাবর পানিতে দাঁড়িয়ে আছেন। সামান্য ঢেউ এলেই তিনি তলিয়ে যাবেন।"
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক) বলেন, "প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছেন। তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা দরকার। ইতোমধ্যে ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখা ও কাবিটার মতো প্রোগ্রাম চালু আছে। কিন্তু এগুলো সবার জন্য উপযুক্ত নয়। অনেক মানুষ আছেন যারা সংজ্ঞা অনুযায়ী দরিদ্র নন, কিন্তু সহযোগিতা দরকার। তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন।"
বক্তারা বলেন, শহরাঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিস্তারও বাড়াতে হবে।
সামাজিক নিরাপত্তার বাজেট বিশ্লেষণে যা পাওয়া যাচ্ছে
অনুষ্ঠানে 'সোশ্যাল প্রোটেকশন বাজেট অ্যানালাইসিস' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ২০২৫–২৬ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,১৬,৭৩১ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ১৪.৭৮ শতাংশ এবং দেশের জিডিপির ১.৮৭ শতাংশ।
এক দশক আগে ২০১৫–১৬ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩৫,৯৭৫ কোটি টাকা। সেই হিসেবে ২০২৫–২৬ অর্থবছরে বরাদ্দ প্রায় ৩.২৭ গুণ বেড়েছে।
তবে বরাদ্দ বাড়লেও কার্যকর বাস্তবায়ন, সঠিক অন্তর্ভুক্তি এবং বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে সামাজিক নিরাপত্তার সুফল যথাযথভাবে পৌঁছাচ্ছে না। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী-পরিত্যক্ত নারীর ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা এবং খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির বরাদ্দ বেড়েছে।
সরকার সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচি ১৪০ থেকে কমিয়ে ৯৫-এ এনেছে। এতে সমন্বয় ও দক্ষতা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি গভর্মেন্ট-টু-পারসন (জি২পি) ডিজিটাল পেমেন্ট ও ডাইনামিক সিঙ্গেল রেজিস্ট্রি প্রবর্তনের মাধ্যমে সরাসরি সুবিধাভোগীর কাছে অর্থ পৌঁছানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বর্তমান বাজেটে প্রবীণ ভাতার বরাদ্দ বাড়লেও এখনো অনেক প্রবীণ এর বাইরে রয়ে গেছেন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ও একাকী প্রবীণরা সুবিধা পান না।
একইভাবে বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা ও অসহায় নারীদের সহায়তা কর্মসূচির বরাদ্দও সীমিত। ঝুঁকিপূর্ণ নারী পরিবারের সবাইকে এ কর্মসূচির আওতায় আনা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে শুধু ভাতাভিত্তিক সহায়তা যথেষ্ট নয়; সামাজিক সুরক্ষাকে কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্রঋণ, দক্ষতা উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা সবচেয়ে জরুরি। নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরায় সর্বস্ব হারানো মানুষের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। তবে বর্তমান কাঠামোয় উপকূলীয় অঞ্চল, চরাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের বরাদ্দ যথেষ্ট নয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আলাদা 'ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট সাপোর্ট প্রোগ্রাম' চালু করা জরুরি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সামাজিক সুরক্ষাকে দয়া বা অনুদান নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখতে হবে। এজন্য সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে এবং তথ্যভিত্তিক ডেটাবেজ গড়ে তুলতে হবে। এতে সঠিকভাবে সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের দরিদ্ররা বনসাই
মূল প্রবন্ধে অতিরিক্ত সচিব মো. খালেদ হাসান বাংলাদেশের দরিদ্রদের বনসাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, "প্রকৃত গাছ আর বনসাইয়ের বীজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু বনসাই বড় হতে পারে না পর্যাপ্ত মাটি না পাওয়া এবং ডালপালা ছাঁটা হওয়ার কারণে। বাংলাদেশের মানুষের দরিদ্র থাকাও ঠিক তেমন। সুযোগের অভাবে মানুষ দরিদ্র থাকে। সামাজিক ব্যবস্থার কিছু ত্রুটির কারণে অনেকে দারিদ্র্যের ঘেরাটোপে আটকে আছে। তাদের সুযোগ করে দিলে দরিদ্রসীমা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।"
তিনি জানান, এই তুলনাটি টানা হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের ২০০৭ সালের একটি বক্তৃতা থেকে। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, দরিদ্র মানুষ বনসাইয়ের মতো—বীজে কোনো ত্রুটি নেই, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থা তাদের বড় হতে দেয়নি।
জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, "বনসাই কষ্টের সুন্দর। এটা কেউ চায় না। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।"
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, "ন্যায়ভিত্তিক সমাজে চরম দারিদ্র্য থাকতে পারে না। ন্যায় নিশ্চিত করা গেলে কেউ বনসাই হয়ে থাকবে না।"