২০০-এর বেশি রপ্তানিকারককে টাকা দিতে পারছে না সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলো, প্রতিকার চেয়ে আজ গভর্নরের সঙ্গে বিজিএমইএ’র বৈঠক

রপ্তানির অর্থপ্রাপ্তির পরেও আর্থিক সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলো এখন ব্যাক টু ব্যাক এলসির অর্থ এবং রপ্তানিকারকের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। এতে রপ্তানিকারকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। টাকা না পেয়ে তারা শ্রমিকদের মজুরিসহ অন্যান্য ব্যয় বহন করতে পারছেন না। ফলে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি করেছে এক্সিম ব্যাংক ও এসআইবিএল। কেবল এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমেই ২৫৪টি পোশাক রপ্তানিকারক রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করে, যাদের বড় অংশের টাকা আটকে গেছে।
তবে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোতে ঠিক কত পরিমাণ এক্সপোর্ট প্রসিড বা রপ্তানি আয় আটকে আছে, সে তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সূত্র জানিয়েছে, সংগঠনের নেতারা আজ মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই সমস্যার প্রতিকার চাইবেন।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু টিবিএসকে বলেন, "সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলো টাকা না দেওয়ায় দুই শতাধিক পোশাক রপ্তানিকারক বিপাকে পড়েছেন। তাদের ব্যাক টু ব্যাক এলসির অর্থও পরিশোধ হচ্ছে না, আবার রপ্তানিকারকও টাকা পাচ্ছেন না। এই টাকা না পেলে কারখানা শ্রমিকদের বেতন দেব কীভাবে? আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এর দ্রুত প্রতিকার চাইব।"
রপ্তানিকারক সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে গত রোববার পোশাক শিল্প মালিকদের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. জাকির হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ওই দলে ১১ জন রপ্তানিকারক ছিলেন, যারা রপ্তানির টাকা না পেয়ে সমস্যায় আছেন।
প্রতিনিধি দলে থাকা এক রপ্তানিকারক—যার এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার—নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানান, "শুধু এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমেই ২৫৪টি রপ্তানিকারক ব্যবসা করছে। তাদের প্রায় সবাই সমস্যায় পড়েছেন। এক্সপোর্ট প্রসিড আসার পরও ব্যাংক টাকা পরিশোধ করছে না।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা আগামীকাল (আজ) গভর্নরের সঙ্গে দেখা করব। সমাধান না পেলে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরব।"
একইভাবে হান্নান গ্রুপও মারাত্মক সংকটে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির বড় অংশ এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে হয়। কিন্তু এখন তারা কোনো অর্থ পাচ্ছে না।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম শামসুদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "আমি এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট জমা দিয়েছি। রপ্তানির অর্থ দেশে আসার পরও ব্যাংক আমাদের ব্যাক টু ব্যাক এলসির টাকা পরিশোধ করছে না, আবার আমাদের অংশও দিচ্ছে না। ডলার হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক সব ডলার গিলে খাচ্ছে।"
"আমার মিলিয়নস অব ডলার রপ্তানির টাকা দেশে আসছে, কিন্তু ব্যাংক সেগুলো গিলে ফেলছে, এটা কীসের আলামত? এই টাকা কোথায় যায়? তারা টাকা নিয়েও (গ্রহকদের) ফকির করছে, এখন রপ্তানির টাকা নিয়েও ফকির করে দিচ্ছে," বলেন তিনি।
সাধারণত রপ্তানিকারকের পক্ষে এখানকার ব্যাংককে আমদানিকারক দেশের ক্রেতা ওই দেশের স্বীকৃত ব্যাংকের মাধ্যমে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) দেয়, যা মাস্টার এলসি নামে পরিচিত। রপ্তানি পণ্য গন্তব্যে পৌঁছালে ব্যাংকটি রপ্তানিকারকের ব্যাংকে অর্থ পাঠায়।
মাস্টার এলসির বিপরীতে রপ্তানিকারক নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে স্থানীয় ব্যাংক থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল পান, যা দিয়ে তিনি কাঁচামাল ক্রয় করেন।
রপ্তানির অর্থ দেশে এলে ব্যাংক ব্যাক টু ব্যাক এলসির টাকা রেখে নিয়ম অনুযায়ী বাকি টাকা রপ্তানিকারককে দেয়। একইসঙ্গে, যেসব প্রতিষ্ঠানকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে কাঁচামাল সরবরাহের দায়বদ্ধতা থাকে, তাদের পাওনাও মিটিয়ে দেয় ব্যাংক।
কিন্তু বর্তমানে সমস্যাগ্রস্ত কয়েকটি ব্যাংক টাকা পরিশোধ করতে পারছে না।
ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে কাঁচামাল সরবরাহ করে টাকা না পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হলো এনজেড টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউদ জামান খান টিবিএসকে বলেন, "আমি এক্সিম ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল সরবরাহ করেছি। কিন্তু গত নয় মাস ধরে কোনো টাকা পাচ্ছি না। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোতে আমার এক মিলিয়ন ডলার আটকে আছে।"
তিনি আরও বলেন, "ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, সমস্যাগ্রস্ত পাঁচটি ব্যাংক মার্জ হওয়ার আগে কোনো পেমেন্ট দেওয়া সম্ভব নয়। এতে আমরা মারাত্মক বিপদে পড়েছি।"
যোগাযোগ করা হলে সমস্যাগ্রস্ত শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানান, "আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ৩০০ রপ্তানিকারক রপ্তানি কার্যক্রম চালান। তবে যাদের টাকা আটকে আছে, তাদের সংখ্যা ৪০টির বেশি হবে না।"
তিনি বলেন, "ব্যাংক মার্জ করা হবে এমন ঘোষণার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ আর টাকা ডিপোজিট করছে না। ফলে আমরা পরিশোধ করতে পারছি না। গ্রাহকেরা হুড়মুড় করে টাকা তুলতে আসছেন। সমস্যা গত জুন থেকে মারাত্মক আকার নিয়েছে।"
সরকারের সিদ্ধান্তহীনতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, "যদি মার্জ করতেই হতো, তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যেই করে ফেললেই হতো। বারবার আলোচনার দরকার ছিল না।"
এদিকে, এসআইবিএল'র ভাইস চেয়ারম্যান মাকসুদা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সফল হয়নি।