ডাকসু নির্বাচনে ভোটারের প্রায় অর্ধেক নারী, প্রার্থী মাত্র ১৩ শতাংশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নারী শিক্ষার্থীরা মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক হলেও প্রার্থী হিসেবে তাদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভোট ও প্রার্থীপদে নারীর অংশগ্রহণের মধ্যে বড় ধরনের বৈষম্য রয়ে গেছে।
ভোটার তালিকা অনুযায়ী, আসন্ন নির্বাচনে মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। এর মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ১৮ হাজার ৯৫৯ জন (৪৭.৬ শতাংশ) এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ২০ হাজার ৯১৫ জন (৫২.৪ শতাংশ)।
ভোটারের সংখ্যায় প্রায় সমান হলেও প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা অনেক পিছিয়ে আছেন।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ৪৬২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র ৬০ জন (১৩ শতাংশ) আর পুরুষ প্রার্থী ৪০২ জন (৮৭ শতাংশ)।
হল পর্যায়ে চিত্রটি কিছুটা ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলে মোট ২৩৪টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এক হাজার ১০৮ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নারী প্রার্থী ১৮৮ জন (১৭ শতাংশ) এবং পুরুষ প্রার্থী ৯২০ জন (৮৩ শতাংশ)।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নারীদের প্রার্থীসংখ্যা কম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ছাত্রী হলের স্বল্পতা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র পাঁচটি হল রয়েছে- রোকেয়া হল, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল, শামসুন্নাহার হল, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল এবং কবি সুফিয়া কামাল হল।
তবুও এবারের নির্বাচনে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে বড় দুই প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দুইজন নারী নেতা। তাদের একজন বামপন্থি জোট 'প্রতিরোধ পর্ষদ'-এর প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি। আরেকজন ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক নেতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, যিনি বর্তমানে 'স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য'-এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এছাড়া তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী- মারজিয়া হোসেন জামিলা, জান্নাতি বুলবুল এবং তাহমিনা আক্তারও ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে রয়েছেন মাত্র একজন নারী প্রার্থী- ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত সাবিনা ইয়াসমিন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবিনা বলেন, 'নারী শিক্ষার্থীরা এখনো এই অঙ্গনে নিজেদের জায়গা করে নিতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। অনুকূল পরিবেশের অভাব, প্রতিপক্ষের বুলিং এবং অশালীন মন্তব্য তাদের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রচারণা চালানো আমাদের জন্য বেশ কঠিন। পুরুষ শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারে এবং বেশি সমর্থন পায়, অথচ নারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ভেতরেও নিরাপদ মনে করে না। বাইরের হলগুলোতে গিয়ে প্রচারণা চালানো আমাদের জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ।'
সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে মোট ২৮ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী রয়েছেন চারজন- গণতান্ত্রিক ছাত্র পরিষদের আশরেফা খাতুন, 'সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ'-এর ফাতেহা শারমিন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী সানজানা আফিফা ও অদিতি ইসলাম।
তবে সম্পাদকীয় পর্যায়ের কয়েকটি পদে যেমন আন্তর্জাতিক বিষয়ক, পরিবহন ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে কোনো নারী প্রার্থী নেই।
ভোটার তালিকায় প্রায় অর্ধেক নারী থাকলেও প্রার্থীসংখ্যা এত কম হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে লিঙ্গ বৈষম্যের একটি স্পষ্ট প্রতিফলন। সাধারণ আসন হোক বা নির্বাহী পদ, নারীদের অংশগ্রহণ এখনো খুবই কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শেখ ইমতিয়াজ এ বৈষম্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'ডাকসু বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে আলাদা নয়, আর এই সংস্কৃতি মোটেই নারী-বান্ধব নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'জুলাই আন্দোলনের পর সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। গণ-সংস্কৃতি ও মোরাল পুলিশিং বেড়ে গেছে, যা নারীদের মুক্তভাবে চলাফেরার অধিকার খর্ব করছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের নারী সহকর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দায়িত্বশীল আচরণ করছে না।'
তবুও নারী নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র প্যানেল এবং একাধিক উচ্চপদে নারী প্রার্থীর উপস্থিতি ধীরে ধীরে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।