পিপিপি ভিত্তিতে জরাজীর্ণ দিনাজপুর ও দারোয়ানী টেক্সটাইল মিলস ফের চালুর উদ্যোগ সরকারের

ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের সদরপুর এলাকায় পুরোনো বাঁশের মাচায় ক্লান্ত দেহে শুয়ে আছেন দিনমজুর ওয়াব আলী। এর ঠিক উত্তর দিকেই দাঁড়িয়ে আছে দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলস। মাঝখানে শুধু এই ব্যস্ত মহাসড়ক। নির্বাক চোখে মিলের জীর্ণ ভবনের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে কিছু বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব এই মানুষটি।
"ভাবতে অবাক লাগে, এই কারখানায় কাজ করেই কেটেছে জীবনের অনেকটা সময়," স্মৃতিচারণ করলেন ওয়াব আলী।
ভাদ্রের তপ্ত রোদে চিকচিক করছে মহাসড়কের পিচ। অথচ একসময়ের গতিশীল টেক্সটাইল মিলস এখন জীর্ণশীর্ণ, প্রাণহীন। দিনের আলোতেও অন্ধকার আর সন্ধ্যা নামলেই ভুতুরে পরিবেশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মচাঞ্চল্যে ভরা এ কারখানা এখন পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত স্থাপনায়।
মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখন দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন ওয়াব আলী। অবসর পেলেই আসেন মিলের বিপরীতে এই বাঁশের মাচায়। মনে পড়ে যায় একসময় শত শত শ্রমিকের কর্মচাঞ্চল্যে ভরা দিনগুলোর কথা। অনেকে এখানে বসতি গড়েছিলেন, বন্ধুত্ব হয়েছিল অসংখ্য মানুষের সঙ্গে। এখন আর করো সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। তাই মাচায় বসে স্মৃতির ভেতর ডুবে যান ওয়াব, তারপর সন্ধ্যা নামার আগেই ফেরেন বাড়ি।
মিল পুনরায় চালু হওয়ার খবর শুনলেই আশায় বুক বাঁধেন ওয়াব আলী। বললেন, "বেঁচে থাকতে দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলস আবার পুরোপুরি সচল হতে দেখলে শান্তি লাগবে।"
সম্প্রতি সরকার বন্ধ হয়ে যাওয়া টেক্সটাইল কারখানাগুলো পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। ইতোমধ্যে দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলস ও নীলফামারীর দারোয়ানী টেক্সটাইল মিলস সচল করতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
গত ২৯ জুলাই সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতকে আরও গতিশীল করতে এই দুটি মিল আধুনিকায়ন ও পুনঃউন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের আওতাধীন পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি (পিপিপিএ) বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার আহ্বান করেছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ও পিপিপি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক কাজী ফিরোজ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "এ পর্যন্ত দুটি টেক্সটাইল মিলের দরপত্রে চারটি কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এগুলো দেশের খ্যাতনামা বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ, যাদের শক্তিশালী ব্যবসায়িক সক্ষমতা রয়েছে।"
তবে দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান থাকায় তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানান। একই সঙ্গে দরপত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এদিকে, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলস ও নীলফামারীর দারোয়ানী টেক্সটাইল মিলস পিপিপি পদ্ধতিতে পুনরায় চালুর অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য আজ বুধবার (২০ আগস্ট) একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উত্তরাঞ্চলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নতুন প্রাণ ফিরবে।

জরাজীর্ণ অবস্থায় দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলস
দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলসের বর্তমান অবস্থা বেশ করুণ। ১৯৭৫ সালে প্রয়াত মন্ত্রী কামরুজ্জামান মিলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রায় ৩৮ একর জমির ওপর ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই কারখানা ১৯৭৮ সালে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করে এবং ১৯৮০ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন মন্ত্রী মনসুর আলী।
সেসময় ২৫ হাজার ভারতীয় টাকু দিয়ে মিলের কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে ২০, ৩২, ৪০, ৬০ ও ৮০ কাউন্টের উন্নতমানের সুতা উৎপাদিত হতো। একাধিকবার 'সেরা বস্ত্রকল' হিসেবে জাতীয় স্বীকৃতি পেয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান। তবে ক্রমাগত লোকসানের কারণে সর্বশেষ ২০০৭ সালে ৫ কোটি টাকা ক্ষতি নিয়ে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়।
মিল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রায় ১৯ বছর বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকদের অনেকে চাকরির বয়স হারিয়েছেন। চুক্তিভিত্তিক যারা ছিলেন, তারাও বেতন বকেয়া থাকায় অন্যত্র চলে গেছেন। সুতা ও তুলা রাখার পাঁচটি বড় গোডাউন এখন ভুট্টা মজুতের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
মিলের ব্যবস্থাপক ও ইনচার্জ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, "মিলের যন্ত্রপাতি শতভাগ অকেজো। ভবনগুলোও সংস্কারের অভাবে প্রায় পরিত্যক্ত। প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র অচল, বিদ্যালয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। এত বড় জায়গায় এখন আমি একাই কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে আছি, সঙ্গে মাত্র ৮ টজন নিরাপত্তা প্রহরী।"
"বাস্তবে এখানে নতুন করে কারখানা গড়তে হলে কেবল জমিই ব্যবহার করা সম্ভব। সব দিক বিবেচনায় নিলে বেসরকারি উদ্যোগে হলেও মিল চালু রাখা দরকার। এতে উত্তরের মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং দেশীয় সম্পদ রক্ষা পাবে," যোগ করেন তিনি।
দারোয়ানী টেক্সটাইল মিলসেরও একই দশা
একসময় কোলাহল, সাইরেনের শব্দ আর হাজারো শ্রমিকের প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর ছিল নীলফামারীর দারোয়ানী টেক্সটাইল মিলস। উত্তরাঞ্চলের গর্ব এই প্রতিষ্ঠান ১৯৮০ সালে প্রায় ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫ হাজার ৫৬টি জার্মান টাকু নিয়ে উৎপাদন শুরু করে। মানসম্মত সুতা উৎপাদন করে দেশ-বিদেশে বাজার তৈরি করেছিল।
তবে ১৯৯৫ সালে লোকসানের অজুহাতে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়েন এক হাজারের বেশি শ্রমিক ও কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে চুক্তিভিত্তিক ও ভাড়ার মাধ্যমে কিছুদিন চালু থাকলেও ২০২২ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর টেন্ডারের মাধ্যমে এর যন্ত্রপাতিও বিক্রি করা হয়েছে।
দারোয়ানী টেক্সটাইল মিলসের ব্যবস্থাপক ও ইনচার্জ মো. জাহির হোসেন জানান, "চারটি গোডাউনের মধ্যে তিনটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাকি একটি ভাড়া দেওয়ার জন্য টেন্ডার করা হলেও আগ্রহী পাওয়া যায়নি। অন্যান্য ভবনগুলো এতটাই অযত্নে নষ্ট হয়েছে যে, সংস্কার না করলে এখন ব্যবহার করা যাবে না।"
"বর্তমানে আমি একাই কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে আছি, সঙ্গে দৈনিকভিত্তিক ১৬ জন কর্মচারী। তবে কাজ না থাকলে তাদেরও আয় থাকে না। নতুন করে উৎপাদন শুরু করতে চাইলে সব যন্ত্রপাতি নতুনভাবে বসাতে হবে। এক কথায়, এখানে কেবল জমিটাই ব্যবহারযোগ্য," যোগ করেন তিনি।