কিছু বন্ধ পাটকল, চিনিকল ও টেক্সটাইল মিলকে অর্থনৈতিক অঞ্চল বানানোর পরিকল্পনা সরকারের

সরকার দেশের কিছু বন্ধ পাট ও চিনি কল এবং টেক্সটাইল মিলকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপান্তর করার পরিকল্পনা করছে, যাতে অব্যবহৃত জমি ও অবকাঠামোর আরও ভালো ব্যবহার এবং শিল্প প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায়।
বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে পুনর্ব্যবহারের কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে গত বছরের ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) গভর্নিং বোর্ডের সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন গভর্নিং বোর্ড সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ উইনূস।
সভা সূত্রে জানা গেছে, বেজা প্রাথমিকভাবে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এভাবে রূপান্তরের পরিকল্পনা করছে—ঢাকার করিম জুট মিলস লিমিটেড, কুষ্টিয়া সুগার মিলস লিমিটেড ও কুষ্টিয়ার মোহিনী টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড।
সূত্র জানিয়েছে, পরবর্তীতে এমন আরও বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা নিয়েছে বেজা।
এর আগে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন সাংবাদিকদের।
জানুয়ারিতে বেজার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'আগামী দুই বছরে আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে কাজ করব। এর বাইরে পরিকল্পনা আছে বন্ধ জুট মিল ও সুগার মিলকে অর্থনৈতিক অঞ্চল করার। কারণ সেখানে সরকাররের অনেক জমি অধিগ্রহণ করা আছে, হয়তো সেখানে ভবনও আছে।
'অনেক জমি খালি পড়ে রয়েছে। সেইসব জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ আছে, পানির সহজপ্রাপ্যতা আছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।' কিছু বন্ধ মিলে ইউটিলিটি সেবা থাকায় তাই বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা সহজ হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন সব পাটকল এখন বন্ধ আছে। আর্থিক ক্ষতি ও শ্রমিক অসন্তোষ দেখিয়ে ২০২০ সালের জুলাইয়ে বিজেএমসির ২৫টি মিলের উৎপাদন কার্যক্রম একযোগে বন্ধ করে দেয় সরকার।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। বিপুল আর্থিক ক্ষতি ও তাদের কার্যকারিতা বাড়াতে আধুনিকীকরণের পরিকল্পনার জন্য এসব মিল বন্ধ করা হয়।
বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সহজপ্রাপ্য নয়। তবে বিভিন্ন প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনের (বিটিএমসি) অধীনে প্রায় ২৩টি মিল বন্ধ হয়ে গেছে, কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দেওয়া হয়েছে অথবা অন্য ব্যবহারের জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে।
জানুয়ারিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এর অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বন্ধ পাটকল ও টেক্সটাইল মিলগুলো লিজের মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে ছেড়ে দিতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।
'বর্তমানে ৫০টির মতো বন্ধ মিল থাকলেও ইতিমধ্যে তিনটি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় আছে আরও কয়েকটি মিল,' বলেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, পণ্যের বাজার চাহিদা হ্রাস এবং বিভিন্ন অব্যবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা এসব রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে শিল্প অঞ্চলে অবস্থিত এসব মিলের জমি ও অবকাঠামো নতুন শিল্প বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে না। অথচ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য এসব জায়গা খুবই উপযোগী; বিনিয়োগকারীদের কাছে চাহিদাও রয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনায় থাকা ৩ বন্ধ মিলের বর্তমান অবস্থা
বন্ধ থাকা তিন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিলের প্রাথমিক মূল্যায়ন করেছে বেজা। মূল্যায়নের পর মিলগুলোকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপান্তরের উপযোগী মনে করেছে।
করিম জুট মিলস লিমিটেড: বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের আওতাধীন এই পাটকল ঢাকার ডেমরায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৪৯.৬২ একর জমির ওপর অবস্থিত।
এই এলাকায় একটি পাটকল, গুদাম, প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবন, একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, লজিস্টিকক স্থাপনা, তিনটি বড় পুকুর ও খালি জমি রয়েছে।
অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ড্রেনেজ সিস্টেম, সীমানাপ্রাচীর এবং নদীপথে পরিবহনের জন্য একটি জেটি। এ এলাকায় উপযোগ চাহিদা মেটানোর জন্য একটি ১১ কেভি সাবস্টেশন, গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা এবং গভীর নলকূপ রয়েছে।
সুলতানা কামাল সেতুর কাছে হওয়ায় এখানে উৎপাদিত পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের সব এলাকার পরিবহন সহজতর হয়েছে।
এ মিল এলাকায় ব্যবহারোপযোগী অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো ছাড়াও প্রয়োজনীয় অফসাইট অবকাঠামো, সামাজিক অবকাঠামো এবং ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্প শ্রমিকের জোগান রয়েছে ।
কুষ্টিয়া সুগার মিলস লিমিটেড: বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন পরিচালিত এই মিল ১৯৬১ সালে কুষ্টিয়ার জগতিতে ২২১.৪৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই শিল্প কমপ্লেক্সে একটি চিনি কারখানা, বাণিজ্যিক খামার, জৈবসার কারখানা এবং প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবন রয়েছে। এছাড়া রয়েছে উৎপাদিত পণ্য গুদামজাতকরণের জন্য দুটি বড় গোডাউন আছে।
মিল এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি ৩৩১.১১ কেভি সাবস্টেশন ও বিতরণ লাইন নির্মিত হয়েছে। পানি সরবরাহের জন্য আছে গভীর নলকূপ। সমগ্র মিল এলাকায় অভ্যন্তরীণ রাস্তা রয়েছে ।
মিলটি যশোর-রাজশাহী মহাসড়কের কুষ্টিয়া বাইপাসের কাছে অবস্থিত হওয়ায় পণ্য পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। ২০২০ সালে এ মিল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
মোহিনী টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড: বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প কর্পোরেশনের আওতাধীন মোহিনী টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড কুষ্টিয়া শহরের মিল পাড়া এলাকায় ৯৯ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত।
মোট জমির মধ্যে ২৮ বিঘা জমির ওপর মূল কারখানা ভবন নির্মিত হয়েছে। বাকি জমি বিভিন্ন সামাজিক অবকাঠামো খাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
মিল এলাকায় নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে।