বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রকল্পে এডিবির বিপুল বিনিয়োগের কড়া সমালোচনা

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের শতাধিক প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১ হাজার ৭ ৩৪ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। তবে এর বড় অংশই জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর প্রকল্পে যাওয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে সংস্থাটি।
সুশীল সমাজভিত্তিক সংগঠন 'এনজিও ফোরাম অন এডিবি' জানিয়েছে, ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশে এডিবি মোট ১০৬টি জ্বালানি প্রকল্পে সহায়তা দিয়েছে, যার একটি বড় অংশ ব্যয় হয়েছে তেল-গ্যাস বিতরণ, জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন অবকাঠামোতে।
এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৬৭টি প্রকল্প, যার মোট মূল্য ৯৮৪ কোটি ডলার, ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে এই ধরনের অর্থায়নের পেছনে— প্রকল্প পরিকল্পনা, টেকসইতা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংশ্লিষ্টরা।
তাঁরা বলছেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এমন একমুখী বিনিয়োগ নীতির ফলে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।
আজ মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর বাংলামোটরে আয়োজিত 'বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এডিবির বিনিয়োগ ঝুঁকি উন্মোচন' শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য উঠে আসে।
ইতালির মিলানে এডিবির ৫৮তম বার্ষিক সাধারণ সভার আগে— যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এনজিও ফোরাম ও কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভাইরনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন)। এসময় বক্তারা বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এডিবির দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ মডেলের কড়া সমালোচনা করেন। তারা জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে এডিবির প্রতি আহ্বান জানান।
এনজিও ফোরামের বিশ্লেষণ বলছে, বাংলাদেশে এডিবির ৬৫ শতাংশ প্রকল্পে কোনো প্রকার সুরক্ষা শ্রেণিকরণই নেই, যা স্পষ্টতই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশগত প্রকল্পে বরাদ্দ ৭.৯৫ শতাংশ, আর বাস্তুচ্যুতি ও স্থানীয়দের সুরক্ষায় বরাদ্দ মাত্র ০.৩৫ শতাংশ।
এনজিও ফোরাম অব এডিবির জীবাশ্ম জ্বালানি প্রচারাভিযানকারী শারমিন বৃষ্টি বলেন, 'এই পরিসংখ্যান এডিবির টেকসই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।'
এনজিও ফোরাম অন এডিবির নির্বাহী পরিচালক রায়ান হাসান, এডিবির জীবাশ্ম জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগের বৈষম্য ব্যাখ্যা করে বলেন, 'এডিবি বাংলাদেশে দুই হাজার ৮৮৪.৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মোট ৪.৮৮ বিলিয়ন (৪৮৮ কোটি) ডলার বিনিয়োগ করেছে। যার মধ্যে ৮২.৯ শতাংশ অর্থায়ন যায় জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর প্রকল্পে, এবং মাত্র ২.৫৫ শতাংশ সৌরবিদ্যুতে। আর বায়ুবিদ্যুতে এখন পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রতি মেগাওয়াটে জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্পে বিনিয়োগ ২.০৪ মিলিয়ন ডলার, যেখানে সৌরবিদ্যুত প্রকল্পে তা মাত্র ০.৫১ মিলিয়ন ডলার, যা বেশ উদ্বেগজনক।'
তিনি বলেন, 'এডিবির জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানি নীতি সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে সক্রিয়ভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধীরে ধীরে বন্ধ করার কৌশল গ্রহণ করতে হবে, একটি ন্যায়সংগত ও সমতাভিত্তিক জ্বালানি রূপান্তরের নেতৃত্ব দিতে হবে। প্যারিস চুক্তির সঙ্গে অর্থায়নকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে যাতে— কার্বন নির্ভরতা রোধ করা যায়'।
এডিবির বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে অর্থায়ন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ক্লিন-এর প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী বলেন, 'বাংলাদেশে গ্যাসের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও এডিবি ভেড়ামারা থেকে খুলনা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে।'
তিনি আরও জানান, "এই কল্পিত গ্যাসের ওপর নির্ভর করেই খুলনায় ২২৫ মেগাওয়াট ও ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অর্থায়ন করেছে এডিবি। অথচ গ্যাসের অভাবে এই প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর বন্ধ পড়ে আছে এবং জনগণের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'বাংলাদেশ জলবায়ু সংকটের সম্মুখভাগে অবস্থান করছে, অথচ এডিবি জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর প্রকল্পে বিনিয়োগ করে আমাদের ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে এবং বাসযোগ্য ভবিষ্যতকে বিপন্ন করছে। তাই, এডিবিকে এখনই তাদের জ্বালানি নীতি বদলে— শুধুমাত্র নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে হাঁটতে হবে।'
সংবাদ সম্মেলনে এনজিও ফোরাম অন এডিবি এবং ক্লিন- এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছে তিনটি প্রধান দাবি উত্থাপন করে। এগুলো হলো— জীবাশ্ম জ্বালানিতে সকল অর্থায়ন বন্ধ এবং ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরে সমর্থন, প্রকৃত সুরক্ষা বাস্তবায়ন ও এফপিআইসি (ফ্রি, প্রায়োর এবং ইনফর্মড কনসেন্ট) নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি রাখা, এবং কার্বন মার্কেট, গ্রিনওয়াশিং ও কর্পোরেট স্বার্থের নামে ছদ্ম জলবায়ু সমাধান প্রত্যাখ্যান করা।