স্বাস্থ্যখাত সংস্কার: পরিকল্পনা অনেক, তবে বাস্তবায়নে অগ্রগতি সামান্য

গত এক বছরে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ওষুধের দাম বাড়েনি। এমনকি, সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানির ৩৩টি জরুরি ওষুধের দাম কমেছে, ক্যান্সারের ওষুধের দাম ৫-১০ শতাংশ কমানো হয়েছে, কমেছে কার্ডিয়াক স্টেন্টের (হার্টের রিং) দামও।
তবে এসব সত্ত্বেও গত এক বছরে স্বাস্থ্যখাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। বরং সেক্টর প্রোগ্রাম বন্ধ থাকায় চলমান অনেক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। আরবান প্রাইমারি হেলথকেয়ারে জিপি ক্লিনিক চালু, ফার্মেসি নেটওয়ার্ক গঠন, এসেনসিয়াল ড্রাগসের তালিকা বাড়ানোসহ নানা পরিকল্পনার কথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলে আসলেও এখনো এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. এ এম জাকির হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত এক বছরে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ওষুধ—এই দুটি বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেক মনোযোগ দিয়েছে। কার্ডিয়াক স্টেন্টের দাম কমানো হয়েছে, ওনারা কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করেছেন। তবে সিস্টেম পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।"
তিনি বলেন, "যতক্ষণ কাঠামোগত সংস্কার হবে না, ততক্ষণ সব উদ্যোগ সীমিত সময়ের জন্য কার্যকর হবে এবং ব্যক্তি-নির্ভর সমাধান হিসেবে থেকে যাবে। ব্যক্তি ভালো হলে কাজ হবে, না হলে হবে না। কাঠামোগত সংস্কার না হলে দীর্ঘমেয়াদে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না।"
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে গত এক বছরে স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী। তারা জানান, খাতটির ১০টি বড় সংকট চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, এই ১০টি সংকট শনাক্ত করতেই যদি এত সময় লেগে যায়, তবে বাস্তবায়ন হবে কবে?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুহাম্মদ আবদুস সবুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভূতের পা যেমন পিছনের দিকে থাকে, স্বাস্থ্য খাতেও তেমন আমরা আগাচ্ছি না, বরং পিছিয়ে যাচ্ছি। গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রেস কনফারেন্স করে জানালেন, আমরা সব সমস্যা জানি—১০টি অসুখ। তারা বললেন, এই দশটি সমাধান করতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো, যদি আগে থেকেই এ ১০টি সমস্যা জানা থাকত, তবে কমিশনের পেছনে এত সময় ব্যয় করলেন কেন? শুরু থেকেই তো এসব সমাধানে সময় দেওয়া যেত। আর এই ১০টি সমস্যা শনাক্ত করতেই যদি এক বছর লেগে যায়, তবে নিশ্চিতভাবেই তারা ভালো চিকিৎসক নন—এটা পরিষ্কার।"
তিনি আরও বলেন, "এই সরকার গত এক বছরে যা করেছে তা শুধু আওয়াজ দেওয়া। ফার্মেসি নেটওয়ার্ক হবে, আরবান ১০০ ক্লিনিক হবে, এসেনসিয়াল ড্রাগসের তালিকা বাড়ানো হবে—এসব মাসের পর মাস শোনা যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। এখনো শুধু ঘোষণা দিয়েই যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশের তিন প্রান্তে তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল হবে। ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচন হয়, হাতে আছে মাত্র পাঁচ মাস—কাজ শুরু করবে কবে?"
ডা. সবুর বলেন, "সরকার কী করবে তার তালিকা আমরা পেয়েছি, কিন্তু কী করেছে তার তালিকায় শুধু দেখা যায় আহতদের চিকিৎসা করা বা বিদেশ পাঠানো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কাজই রোগীর চিকিৎসা করা—এটা কোনো বড় অর্জন নয়। যেমন, বাচ্চারা একটা মহৎ কাজ করতে গিয়ে আহত হয়েছে, তাদের চিকিৎসা তো করতেই হবে।"
তিনি আরও বলেন, "মন্ত্রণালয়ের প্রধানেরা বলেছেন, ৩৭টি মেডিকেল কলেজ ও ৪টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে গিয়ে তারা নিরপেক্ষ লোক পাননি। আসলে তারা নিরপেক্ষ লোক খোঁজেননি। বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব ও জামায়াতপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন এনডিএফ-এর তালিকা থেকে ভারসাম্য রেখে নিয়োগ দিয়েছেন। নিরপেক্ষদের কাছে যাওয়ার সুযোগই দেওয়া হয়নি। অথচ সরকারের সুযোগ ছিল অতীতে দলীয়করণ থেকে বের হয়ে নিরপেক্ষ নিয়োগ দেওয়ার, কিন্তু তারা তা করেনি।"
ডা. সবুর বলেন, "অপারেশনাল প্ল্যান ছাড়াই এক বছরের বেশি সময় কেটে গেছে। কবে এ ঘাটতি পূরণ হবে, সে বিষয়ে কিছুই বলা হচ্ছে না। ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচিত সরকার আসে এবং স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়, সেটিই একমাত্র আশা।"
তিন মাস পার হলেও স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের জন্য গঠিত রিফর্ম কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।'
'রি-স্ট্র্যাটেজিং দ্য ইকোনোমি অ্যান্ড মোবিলাইজিং রিসোর্স ফর ইকুইটেবল অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট' শীর্ষক টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে জনস্বাস্থ্য খাত সংস্কারের সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বে প্রণীত এ প্রতিবেদনে প্রথম ধাপে ঢাকার একটি নির্বাচিত সরকারি হাসপাতাল দিয়ে সংস্কার শুরু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
সুপারিশে বলা হয়, পেশাদার প্রশাসক নিয়োগ, নতুন গভর্নিং বোর্ড গঠন, অভিযোগ ও কর্মদক্ষতা পর্যবেক্ষণে রিয়েল-টাইম ড্যাশবোর্ড চালু এবং যুব ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে অনলাইনে গুরুত্বপূর্ণ সূচকে প্রবেশাধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি বামরুনগ্রাদ বা গ্লেনিগলসের মতো শীর্ষ হাসপাতাল গ্রুপের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) তৃতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবায় অনুমোদনেরও প্রস্তাব করা হয়। এসব সুপারিশের কোনোটিই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের রিসার্চ এডিটর ডা. নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই সরকার যদি স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, অনিয়ম বা দলীয় প্রভাবের অভিযোগ মোকাবিলায় সুস্পষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করে স্বচ্ছ ও পুনরাবৃত্তিযোগ্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কার করত, তবে তা ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকারগুলোর জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। এখন সময় কম, তাই বড় বড় কথা না বলে সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মতভাবে এক-দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিয়ে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি।"
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল বদলি ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। নেতৃত্ব পরিবর্তনেও রাজনৈতিক প্রভাব আগের মতোই রয়ে গেছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে ৮,২৭৬ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। তবে বঞ্চিত অনেক চিকিৎসক পদোন্নতি পেয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতে জনবল সংকট এখনও আগের মতোই প্রকট।
সেক্টর প্রোগ্রাম না থাকায় স্থবির স্বাস্থ্য খাত
সেক্টর প্রোগ্রামের আওতায় বিভিন্ন অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটাসহ সব কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ২০২৪ সালের জুনে চতুর্থ সেক্টর প্রোগ্রাম শেষ হয়। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেক্টর প্রোগ্রাম থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটি এক্সিট প্ল্যান প্রণয়ন করে।
তবে এখনো এ এক্সিট প্ল্যান বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। ফলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতালে এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন পরীক্ষার উপকরণ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কয়েক মাস ধরে কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধ নেই, জেলা হাসপাতালে অসংক্রামক রোগের ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে র্যাবিস ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিভেনমের ঘাটতি রয়েছে। অ্যান্টিভেনমের অভাবে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যুও ঘটছে নিয়মিত।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্বাস্থ্য খাত রুটিন কাজে সাফল্য দেখিয়েছে, বিশেষ করে মাইলস্টোন স্কুল দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা প্রদানে। অনেক দেরি হলেও পদোন্নতির জট খুলেছে। তবে সেক্টর প্রোগ্রাম থেকে বের হয়ে যে নতুন আর্থিক ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যাচ্ছে, সেটি যেভাবে সংগঠিত হওয়া দরকার ছিল, তা কার্যত সম্ভব হয়নি।"
"সংস্কারের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি হয়নি, যদিও আগ্রহ আছে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার একটি একক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কঠিন—এটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের বিষয় এবং প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন," যোগ করেন তিনি।
যত আন্দোলন সামলাতে হয়েছে
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশে ১৬টি সরকারি ম্যাটস ও প্রায় ২০০ বেসরকারি ম্যাটস কলেজ চালু হয়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী পাস করলেও চাকরির সুযোগ কম থাকায় তারা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসেরও বেশি সময় আন্দোলন করেন। এ আন্দোলন সামলাতে হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে।
কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের অধীনে নিয়োগ পাওয়া স্বাস্থ্যকর্মীরাও দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছেন।
এছাড়া, স্বতন্ত্র কাউন্সিল গঠনের দাবিতে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা জুলাই থেকে আন্দোলন করছেন। হলের দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রতিষ্ঠানটি ২০ দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কী বলছে সরকার?
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১০টি বড় সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। সব কাজ একসঙ্গে শেষ করা সম্ভব না হলেও ধাপে ধাপে এগিয়ে নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, "মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। মেডিকেল শিক্ষায় ইন্টার্নশিপ ১৮ মাসের হবে, যার মধ্যে ছয় মাস শিক্ষার্থীকে গ্রামে থাকতে হবে।"
তিনি জানান, মানুষের নিরাপদ ও মানসম্পন্ন ওষুধ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ফার্মেসি নেটওয়ার্ক গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। "মুদিদোকান আর ফার্মেসি এক নয়। ওষুধ দেওয়া একটি বিশেষায়িত কাজ, এর জন্য চাই প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট," বলেন ডা. সায়েদুর। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়িয়ে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্বার্থের দ্বন্দ্ব এড়াতে ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে চিকিৎসকদের সব ধরনের উপহার গ্রহণ বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। জনবল সংকট মোকাবেলায় ৭ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে।
তিনি আরও জানান, স্বচ্ছতার অভাব ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি দূর করতে ক্রয় প্রক্রিয়া (প্রকিউরমেন্ট) ডিজিটালাইজ করা হয়েছে।