তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা, ৩৫ বছর পরও চাকসু নিয়ে নীরব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সম্প্রতি তিনটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর—দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেও এ বিষয়ে নীরব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে।
বছরের পর বছর ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের বিষয়টি বারবার আলোচনায় এলেও তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মৌখিক আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ ছিল।
গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই দাবি নতুন করে গতি পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা তৈরি হয়।
ডাকসু, রাকসু ও জাকসু নির্বাচনের তারিখ যথাক্রমে ৯, ১১ ও ১৫ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখনও জানেন না কবে হবে চাকসু নির্বাচন।
চবি কর্তৃপক্ষ বলছে, আজ (১ আগস্ট) সিন্ডিকেট সভায় চাকসু নির্বাচনের নীতিমালা চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তবে কোনো কার্যকর ফলের ব্যাপারে সন্দিহান ছাত্র সংগঠনগুলো। তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, নির্বাচনের সুস্পষ্ট তারিখ ঘোষণা না করা হলে তারা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যাবে।
চবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত করা, তাদের সমস্যা প্রশাসনের কাছে তুলে ধরা এবং সার্বিক শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে চাকসু নির্বাচন না হওয়ায় এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি অচল হয়ে পড়েছে।
তারা আরও বলেন, চাকসু না থাকায় অকার্যকর হয়ে আছে হলভিত্তিক সংসদও। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিনেটে ৫ জন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকার কথা থাকলেও চাকসু নির্বাচন না হওয়ায় ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে সিনেটে এই প্রতিনিধিত্ব নেই।
নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো রোডম্যাপ বা সময়সূচি দিতে পারেনি।
৩০ জুলাই প্রশাসনিক ভবনের সামনে চাকসুর তফসিল ঘোষণার দাবিতে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের বক্তব্য: 'রোডম্যাপ নয়, এখন চাই তফসিল।'
মানববন্ধনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক ও চবির নাট্যকলা বিভাগের খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, দ্রুত চাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শিক্ষার্থীদের 'গণজোয়ারের' মুখে পড়তে হবে।
তিনি বলেন, '১ আগস্ট সিন্ডিকেট সভার পরপরই আমাদের ন্যায্য অধিকার চাকসুর তফসিল ঘোষণা না করলে খোলা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের গণজোয়ার দেখতে পারবেন। তখন আপনাদের প্রশাসনিক ভবনে বসার ক্ষমতা থাকবে না। আপনাদের গদি ধরে টান দেওয়া হবে।'
চবি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান টিবিএসকে বলেন, 'চাকসু নির্বাচন আমরাও চাই, যেহেতু এটা ছাত্রদের দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু ৫ আগস্টের আগে যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাত্রদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছেন বা অংশ নিয়েছেন, তাদের শাস্তি কার্যকর করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনও পুরোপুরি নিরপেক্ষ নয়। আমরা চাই প্রশাসন সব ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছাক। আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে চাকসু নির্বাচন চাই।'
'কিন্তু কোনো গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে দলীয় ব্যক্তিকে দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা হলে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে আমরা তা মেনে নেব না,' হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন নোমান।
চবি শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মোহাম্মদ পারভেজ বলেন, 'আমরা বহু আগে থেকেই চাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। প্রশাসন আমাদের জানিয়েছে, আসন্ন সিন্ডিকেট সভায় নীতিমালা চূড়ান্ত করে শিগগিরই তফসিল ঘোষণা করা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু দেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের সময় ঘোষণা হয়েছে, আমরাও চাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়েই নির্বাচন হোক। তফসিল ঘোষণার ওপরই আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে। যদি প্রশাসন তফসিল ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা আবারও আন্দোলনে যাব।'
ছাত্রনেতারা বলছেন, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে।
তারা বলছেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি চাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষার্থীদের আলোচনা হয়। তখন ১০ কার্যদিবসের মধ্যে খসড়া দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে খসড়াটি আসে ২০ মে, যা থেকে প্রশাসনের গড়িমসি স্পষ্ট হয় বলে মনে করেন ছাত্রনেতারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমনা ক্লাব প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র সাজ্জাদ হোসেন বলেন, 'সিন্ডিকেটে গঠনতন্ত্র পাশ হলেও তফসিল ঘোষণা হতে আরও ১০-১২ দিন সময় লাগবে। ফলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চবিতেই চাকসু নির্বাচন সবচেয়ে পরে হবে।'
গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের চবি শাখার সভাপতি ধ্রুব বড়ুয়া প্রশাসনের বিরুদ্ধে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে বলেন, 'আমরা মনে করি, ছাত্রসংসদ গঠনতন্ত্র এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেখানে সব ছাত্রসংগঠন, ক্লাব এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত রাখা হবে।'
চবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, '১ তারিখ সিন্ডিকেট সভা রয়েছে, সেখানে চাকসু নির্বাচনের নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে। নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা নির্বাচনের শিডিউল (তফসিল) ঘোষণা করব।'
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, 'ছাত্ররাও চাকসু চায়, আমরাও চাকসু চাই। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম মিটিংয়েই শিক্ষার্থীরা চাকসু নির্বাচনের দাবি তুলেছিল। আমরা তাদের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।'
১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠার পরে এখন পর্যন্ত মোট ৬ বার চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে।
সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চাকসু নির্বাচন হয়। ওই বছরের ২২ ডিসেম্বরে ছাত্রনেতা ফারুকুজ্জামান খুন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাকসু কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে।