ক্রমবর্ধমান মানবপাচার ঝুঁকির মধ্যেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার শীর্ষে বাংলাদেশিরা

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকারী দেশগুলোর তালিকায় এখন শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ইউরোপীয় সীমান্ত ও উপকূলরক্ষা সংস্থা ফ্রন্টেক্সের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই অন্তত ৯ হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি এই বিপজ্জনক রুট ধরে ইতালিতে পৌঁছেছেন।
এই যাত্রাপথে লিবিয়ায় আটকে পড়া বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক হন। সেসব শিবিরে তাদের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে জিম্মি করে পরিবার থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। কেউ কেউ প্রাণও হারান।
তবু ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর হয়ে লিবিয়া হয়ে ইতালিগামী এই প্রবণতা থামছে না। গত এক দশকে এই রুট ধরে অন্তত ৭০ হাজার বাংলাদেশি ইউরোপে পৌঁছেছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যমতে, এই বিপজ্জনক যাত্রায় অংশ নেওয়া অধিকাংশ ব্যক্তির বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ অন্তত ১০ থেকে ১২টি জেলা থেকে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে উঠছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক গ্রুপ ব্যবহার করে এই পথ আরও সহজ করে দেওয়া হচ্ছে পাচারকারীদের পক্ষ থেকে।
এই পাচারে যারা প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে আসেন, তারা মামলা করলেও মূল দালাল ও অপরাধীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০২৪ সালেই মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে নতুন করে ১ হাজার ৩৪টি মামলা হয়েছে। পুরোনো মামলাসহ বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার ৫০০টি মামলা চলমান। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার মামলা বিচারাধীন এবং ১ হাজারের বেশি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরীফুল হাসান বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে প্রবেশের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে। অনেকেই এই বিপজ্জনক যাত্রায় প্রাণ হারান। লিবিয়ায় অনেককে আটক করে নির্যাতন করা হয়। তাদের পরিবারকে মুক্তিপণ দিতে বাধ্য করা হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'বিদেশে চাকরি বা শ্রম অভিবাসনের আড়ালে এই মানবপাচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পাচারকারীরা এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরতে পিছিয়ে রয়েছে। উপরন্তু, পাচার সংক্রান্ত মামলাগুলোর সঠিকভাবে বিচারও হচ্ছে না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।'
ফ্রন্টেক্সের তথ্যমতে, লিবিয়া হয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকারীদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই এখন শীর্ষে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুট ধরে অন্তত ৯২ হাজার ৪২৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। এই যাত্রায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
সাম্প্রতিক একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে এ বছরের জানুয়ারিতে। সেসময় লিবিয়ায় কমপক্ষে ২৩ জন বাংলাদেশির পচা-গলা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু নৌকাডুবিতে নিহত হন।
ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইতালিতে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টাকারীদের ৬০ শতাংশের পরিবার স্থানীয় দালালদের প্রলোভনে পড়ে সন্তানদের পাঠিয়েছিলেন। এসব দালাল ভালো চাকরির আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ৮৯ শতাংশ অভিবাসী কোনো কাজ পাননি, বরং চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।
ভ্রমণপথ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে রওনা হয়ে অধিকাংশ মানুষ লিবিয়ায় পৌঁছেছেন দুবাই ও মিশর হয়ে। অন্যান্য সাধারণ রুটের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-ইস্তাম্বুল-দুবাই হয়ে, কাতার হয়ে, দুবাই-সিরিয়া হয়ে এবং কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ঢাকা থেকে লিবিয়া পর্যন্ত।
এই যাত্রাপথে ৬৩ শতাংশ অভিবাসী বিভিন্ন সময়ে আটক হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯৩ শতাংশকে বন্দিশিবিরে রাখা হয়, যেখানে ৭৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মানবপাচারের নতুন কৌশল ও রুট
গত এক বছরে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কাছে পাচারের শিকার ৩২৭ জন বাংলাদেশির পরিবারের পক্ষ থেকে সহায়তার আবেদন এসেছে। এসব ভুক্তভোগী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, আটক হয়েছেন, কারাভোগ করেছেন কিংবা প্রত্যাবাসন শিবিরে বন্দি ছিলেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় এ পর্যন্ত ৮১ জন বাংলাদেশিকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
উদ্ধারপ্রাপ্তদের তথ্য অনুযায়ী, পাচারকারীরা এখন ভিজিট ভিসা, সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্র, কর্মসংস্থানের অনুমতিপত্র এমনকি হজের ভিসাও ব্যবহার করছে।
পাচারের নতুন রুটের মধ্যে রয়েছে দুবাই-লিবিয়া-ইউরোপ, দুবাই-সার্বিয়া-স্লোভেনিয়া-ইতালি এবং সৌদি আরব-রাশিয়া রুট।
এছাড়া বাংলাদেশিরা সাইবার প্রতারণারও শিকার হচ্ছেন। এ বছর মিয়ানমারের কুখ্যাত 'স্ক্যাম সেন্টার' থেকে ১৮ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়েছে।
ইউরোপ পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে পাচারকারীরা এখন বাংলাদেশিদের নেপালেও নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা থাকায় পাচারকারীদের জন্য এটি সহজ হয়ে উঠেছে। গত বছরের নভেম্বরে হবিগঞ্জের তুহিনুর ইসলাম অনিক, রহিম খন্দকার ও শাকিব আহমেদ নামের তিনজনকে ছয় মাস পর নেপাল থেকে উদ্ধার করা হয়।
মানবপাচারের রুট হিসেবে নতুনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, তিউনিসিয়া, রাশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও সার্বিয়াকেও।