জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই জাতীয় সনদ কী, বাস্তবায়ন কবে-কীভাবে

গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লেখেন, 'কমরেডস, ৩১ ডিসেম্বর! নাউ অর নেভার।'
এর কিছুক্ষণ পরে আরেকটি পোস্টে তিনি লেখেন, 'প্রক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন, ৩১ ডিসেম্বর, শহীদ মিনার, বিকেল ৩টা।'
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন নেতারা 'সেকেন্ড রিপাবলিক, জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই প্রক্লেমেশন'সহ নানা শব্দ ব্যবহার করে প্রচারণা ও অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে শুরু করেন।
আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম ঘোষণা দেন- ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করবে।
প্রেস সচিবের ঘোষণা অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে যেই ঘোষণাপত্র জারির কথা ছিল, সেটা আগামী ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীতে হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।
এর আগেও আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে গত ১০ মে উপদেষ্টা পরিষদ ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র জারির কথা বলেছিল। তবে সেটাও বাস্তবায়ন হয়নি।
জুলাই ঘোষণাপত্র কী, সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত নিয়ে ভিন্নমত
জুলাই ঘোষণাপত্র হচ্ছে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র।
এ ঘোষণাপত্রে কী কী উল্লেখ থাকবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ আছে। একই সঙ্গে সেটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে ভিন্নমত।
সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে জুলাই ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি ও কার্যকারিতা চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
এ বিষয়ে গত ১১ জুলাই দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছিলেন, 'আমরা বাংলাদেশে নতুন একটি সংবিধান প্রত্যাশা করি। এনসিপি মনে করে, নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে, সেই নতুন সংবিধানের প্রস্তাবনায় জুলাই ঘোষণাপত্র সংযুক্ত করতে হবে। সেই জুলাই ঘোষণাপত্র রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির জায়গায় জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে।'
অন্যদিকে জুলাই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্তের বিষয়ে একমত নয় বিএনপি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘোষণাপত্রের পুরোটা না নিয়ে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের চেতনাটুকু ধারণ করে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চতুর্থ তফসিলে শুধু 'জুলাই অভ্যুত্থান ২০২৪' আনা যেতে পারে।
গত ১০ জুলাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। তখন কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতা শেষ। সেই ঘোষণাপত্র চতুর্থ তফসিলে এসে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, প্রতিটি আইন কিন্তু সংবিধানে উল্লিখিত নয়। বলা হলো, এটা তফসিলে থাকবে, এটাই লেজিটিমেসি (বৈধতা), স্বীকৃতি।
তিনি আরও বলেন, ঘোষণাপত্র লিটারেচার হিসেবে, ডকুমেন্টারি হিসেবে আর্কাইভে থাকে, সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। '৭২–এর সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সংযুক্ত না করা এটা প্রমাণ করে, কোনো ঘোষণাপত্র সংবিধানের অংশ হয় না। ঘোষণাপত্র হলো ঘোষণাপত্র, এটার রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকে, এটা আর্কাইভে থাকে। এটাকে জাতি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উল্লেখ করে, স্মরণ করে।
'আমরা গণঅভ্যুত্থান ২০২৪–এর গুরুত্ব, মর্যাদা, মহিমা ধারণ করি। আমরা এটাকে স্বীকৃতি দিই, জাতি এটাকে স্বীকৃতি দেয়। এটাকে আমরা যথাযথ মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে চাই', বলেন সালাহউদ্দিন।
তিনি বলেন, 'জুলাই ঘোষণাপত্র সম্পর্কে একটা রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ওপর দায়িত্ব বর্তেছে। সরকার এখানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে এ ঘোষণাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা ইতিপূর্বে সে রকম একটা প্রস্তাব পাওয়ার পরে গত ১২ ফেব্রুয়ারি দুজন উপদেষ্টার কাছে আমি নিজেই দলের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্রের বিষয়ে একটা ড্রাফট হস্তান্তর করেছিলাম। কিন্তু আমরা কোনো ফিডব্যাক পাইনি।'
তিনি আরও বলেন, 'কয়েক দিন আগে সরকারের একজন উপদেষ্টা আমাদের মহাসচিবের (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) সঙ্গে যোগাযোগ করে জুলাই ঘোষণাপত্র সংক্রান্ত তাদের একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা আগে যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তার কিছু কিছু বিষয় এটার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমরা দলের সর্বোচ্চ ফোরামের সঙ্গে আলোচনা করে একদিনের মধ্যে আমাদের দলের মতামত ডাফ্রট করে সরকারের সেই উপদেষ্টার কাছে পাঠাই। এখন পরবর্তী সিদ্ধান্ত কী হয়, আলাপ-আলোচনা কী হয়, সেটার জন্য অপেক্ষা করছি।'
বিএনপি জুলাই ঘোষণাপত্রকে চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আর্টিকেল ১০৬ অনুযায়ী গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ এবং কর্মকাণ্ডের বৈধতা চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করে বৈধতা দেওয়া যেতে পারে।'
জুলাই জাতীয় সনদ, কবে-কীভাবে বাস্তবায়িত হবে?
জুলাই জাতীয় সনদ হলো- রাষ্ট্র পরিচালনার যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের ক্ষেত্রে ঐকমত্য হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতোমধ্যে সনদের একটা খসড়া তৈরি করেছে। তাতে সংস্কারের বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়নি। তবে কমিশন জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত মোট ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে ও তা টেকসই করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অঙ্গীকার করতে হবে।
বিএনপি চায় সংস্কারের বিষয়গুলো আগামী জাতীয় সংসদে বাস্তবায়ন করা হোক। যদিও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলছে, গণভোট অথবা অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই সংস্কারের আইনি ভিত্তি তৈরি করতে হবে।
অন্যদিকে এনসিপি নেতারা বলছেন, গণভোট করতে না পারলেও অন্তত প্রেসিডেন্টের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক ওয়ার্ডারের (এলএফও) মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে।
এ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, 'সংলাপে যেসব বিষয়ে একমত হচ্ছি, সেগুলো বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে।'
এক্ষেত্রে তিনি দুটি উপায় প্রস্তাব করেন: এক- অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি আইনি কাঠামো গঠন করে পরে নির্বাচিত সংসদে তা অনুমোদন, দুই- গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া।
খসড়ার বিষয়ে সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন 'এটা অসম্পূর্ণ এবং কিছু অংশ বিপজ্জনক। আজ তারা বলছেন, এটা একটা নমুনামাত্র, ভুল হয়েছে। যদি সেটাই হয়, তাহলে মন্তব্যের দরকার নেই। তবে যদি সেটাই মূল কথা হয়, তাহলে এটা গ্রহণ করা যাবে না।'
জামায়াত একটা খসড়া সনদ তৈরি করছে এবং কমিশনে জমা দেবে বলে জানান তাহের। তিনি বলেন, 'আমরা যেকোনো একটি পদ্ধতিতে এই কাঠামোকে আইনি বৈধতা দিতে চাই।'
তিনি জানান, তারা ঐকমত্যের পক্ষে, কিন্তু সেটা হতে হবে কার্যকর এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে। নাহলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ 'অনিশ্চয়তার দিকে'যেতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।
এ বিষয়ে এনসিপির কয়েকজন নেতা জানান, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট অথবা অধ্যাদেশ অথবা প্রেসিডেন্টের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক ওয়ার্ডার করতে হবে। কমিশন সংস্কার বাস্তবায়নে ছয়টি উপায়ের কথা বলেছে। অথচ এখন একটি দলের পক্ষপাতিত্ব হয়ে জাতীয় সংসদের কথা বলছে।
কমিশন যে ছয়টি উপায়ের কথা বলেছে সেগুলো হলো- নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশ জারি, গণভোট, গণপরিষদ, নির্বাচনের সময় গণভোট, গণপরিষদ ও আইন সভা হিসেবে নির্বাচিত সদস্য অথবা নির্বাচনের পর সংসদের সাংবিধানিক সংস্কার।
গত ১৮ জুন কমিশনের আলোচনা শেষে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ঐকমত্য কমিশন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট ছয়টি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছিল। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের পর ঐকমত্য কমিশন এখন সংস্কারের জন্য সংসদের দিকে ইঙ্গিত করছে।