রংপুরে হিন্দু পাড়ায় হামলা: ‘একজন অপরাধ করে থাকলে গ্রামবাসীর ওপর হামলা কেন?’

মহানবীকে (স.) নিয়ে কটূক্তির অভিযোগের রেশ ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলদাতপুর গ্রামের হিন্দুপল্লীতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটের তিন দিন পরও ওই এলাকার লোকজন আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন। এর মধ্যে কয়েকটি পরিবার এই গ্রাম ছেড়ে অন্য এলাকায় আশ্রয় নেন। কেউ কেউ ভয়ে তাদের মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেন। তবে রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল সোমবার (২৮ জুলাই) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানান, ২২টি পরিবারের মধ্যে ১৯টি পরিবার এখনও নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে।
গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ী ইউনিয়নের একটি গ্রাম আলদাতপুর। ইউনিয়নের এই ওয়ার্ডে প্রায় ২ হাজার হিন্দু ভোটারের বসবাস। হিন্দু অধ্যুষিত এই এলাকায় এখন ভয় আর আতঙ্কে কাটছে স্থানীয়দের সময়। একই ধরণের ঘটনায় বারবার হামলা, লুটপাট ভাঙচুরের কারণে এখন এলাকাবাসীর মনে ভয় ঢুকে গেছে বলে জানান স্থানীয়রা।
ঘটনার সূত্রপাত স্থানীয় এক কিশোরের ফেসবুক স্ট্যাটাসের জের ধরে। অভিযোগ ওঠে, ওই কিশোর ফেসবুকে মহানবীকে (স.) নিয়ে অবমাননাকর লেখা ও ছবি পোস্ট করেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আটক করা হয়।
শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওই কিশোরকে গঙ্গাচড়া থানায় নেওয়া হয়। পরে সাইবার সুরক্ষা আইনে মামলা করে গত রোববার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে সম্মিলিত শিশু পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠানো হয়। ওই কিশোর স্থানীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, ওই কিশোরকে থানায় নেওয়ার পর তার বিচারের দাবিতে উত্তেজিত একদল মানুষ মিছিল নিয়ে তার বাড়ির সামনে যায়। রাত ১০টার দিকে দ্বিতীয় আরেকটি মিছিল এসে তার এক স্বজনের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।
আলদাতপুর গ্রামের পাশেই নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা। সেখানকার একটি এলাকা থেকে একদল ব্যক্তি মাইকে ঘোষণা দিয়ে মিছিল নিয়ে এসে হামলা ও ভাঙচুর করার অভিযোগ ওঠে। প্রথম দিনের হামলায অন্তত ১৪ বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, গত রোববার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আবারও উত্তেজিত জনতা কয়েকটি বাড়িঘরে হামলা চালায়। পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ বলছে, ওই এলাকার দুই দফায় অন্তত ২২টি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি বাড়িঘরের লোকজন এলাকায় রয়েছেন। অন্যরা পাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন বলে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই গ্রামসহ আশপাশের লোকজন আতঙ্ক নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। কেউ কেউ তাদের গরু-ছাগল ও বাড়িতে থাকা আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ বা স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
আলদাতপুর গ্রামের শংকর রায় বলেন, 'ফেসবুকের ঘটনার পর হাজার হাজার মানুষ আমাদের এলাকায় এসে হামলা করেছে। দ্বিতীয় দিনে আবার হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট করেছে। এই অবস্থায় এখন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে। এজন্যই গরু-ছাগলগুলো নিয়ে আমার এক দিদির বাসায় রাখতে যাচ্ছি। গত রোববার তো পুলিশের সামনেই আমাদের ঘরবাড়িগুলো ভাঙচুর এবং লুটপাট করা হয়।'

আলদাতপুর গ্রামের বাসিন্দা নারায়ণ মহন্ত বলেন, গত রোববারের হামলায় বাড়িঘর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 'আমাদের দাবি, যে অপরাধ করেছে তাকে শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু একজনের অপরাধের দায়ভার কেন আমাদের পুরো গ্রামবাসীর ওপর দেওয়া হলো?' বলেন তিনি।
রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালিয়ে একটি বাড়ি করেছিলেন নারয়ণ। এখন সেই বাড়ির প্রায় সব শেষ। তিনি বলেন, 'হামলাকারীরা মানববন্ধন ও মিছিল করবে বলে এসে পুলিশের সামনে ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে। এ সময় পুলিশ শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে; তারা ভয়ে কেউ আসেনি। আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর এত অত্যাচার কেন? আমরা চাই এর সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন মনের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে—কখন যে কী হয়। তাই লুটপাট হয়ে যাওয়ার ভয়ে বাড়িতে থাকা অবশিষ্ট জিনিসপত্র দূরে আত্মীয়ের বাড়িতে রাখতে যাচ্ছি।'
যে কিশোরের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হিন্দুপাড়ায় হামলা, তার ফুফুর নাম নিয়তি রানী। ঘটনার দিন বাবার বাড়িতে এসেছিলেন। নিয়তি বলেন, 'হামলার খবর শোনার পরপরই আমরা ভয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাই। পরে এসে দেখি আমার বাবার বাড়ির সব ভাঙচুর আর লুটপাট করা হয়েছে।'
রবীন্দ্রনাথ রায়ের ভাতিজার ছেলে ওই কিশোর। রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'ঘটনার পরদিনেও এক ঘণ্টা ধরে আমাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। প্রশাসনকে বারবার বলার পরও তারা গুরুত্ব দেয়নি। পুলিশ গুরুত্ব দিলে দ্বিতীয় দিনের লুটপাট হতো না।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গংগাচড়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল এমরান বলেন, 'পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। অপরাধীদের ধরতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।'
এই হিন্দুপাড়ায় হামলার ঘটনা ঘটতে পারে—এমন খবর শোনার পর গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান খান পুলিশসহ সব দপ্তরকে জানিয়েছেন বলে দাবি করেন। এরপরও এমন ঘটনাকে কীভাবে ঘটল, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
এদিকে আজ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি ইউনিয়নের আলদাদপুর বালাপাড়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি মেরামতের কাজ আজ থেকেই শুরু হচ্ছে।