২০ শ্রমিক হলেই ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ দিতে চায় সরকার, বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা খাত সংশ্লিষ্টদের

কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে প্রয়োজনীয় সদস্যসংখ্যা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, একটি ইউনিয়ন গঠনে কারখানার মোট কর্মীর অন্তত ২০ শতাংশের সমর্থন প্রয়োজন। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী, কেবল ২০ জন শ্রমিক একত্রিত হলেই গঠন করা যাবে ট্রেড ইউনিয়ন।
এছাড়া, একটি কারখানায় সর্বোচ্চ তিনটি ট্রেড ইউনিয়নের অনুমতির জায়গায় বাড়িয়ে পাঁচটি ইউনিয়নের অনুমোদনের প্রস্তাবও রাখা হয়েছে খসড়া সংশোধনীতে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে শিল্পমালিক ও শ্রম বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ইউনিয়ন নিবন্ধনের অন্যান্য প্রক্রিয়াও সহজ করা হতে পারে এবং এনজিওসহ সব খাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অনুমতি দেওয়া হতে পারে।
তবে এই প্রস্তাব ইতিমধ্যেই শিল্প খাতের নেতৃবৃন্দ ও বিশেষজ্ঞদের সমালোচনার মুখে পড়েছে। তাদের আশঙ্কা—এতে শিল্প খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে, ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়বে এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়বে।
প্রস্তাবটি সম্প্রতি 'ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদে' (টিসিসি) উপস্থাপন করা হয়, যেখানে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি থাকেন। আগামী ৩১ জুলাই টিসিসির পরবর্তী বৈঠক ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের কারিগরি কমিটিতে এটি আবার আলোচনায় আসবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, 'পরবর্তী সভায় এ সংশোধন চূড়ান্ত করা হবে। চূড়ান্ত হলে ২০ জন শ্রমিক মিলেই একটি ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা যাবে এবং একটি কারখানায় সর্বোচ্চ পাঁচটি ইউনিয়ন অনুমোদন পাবে।'
মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'শতাংশভিত্তিক শর্তের বদলে নির্দিষ্ট সংখ্যার ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে শ্রম সংস্কার কমিশন। আন্তর্জাতিক উদাহরণগুলোতেও এমনটাই দেখা যায়। এটি কার্যকর হলে সব খাতেই, এমনকি এনজিওতেও ইউনিয়ন গঠন সম্ভব হবে।'
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ জানান, ভারতসহ এশিয়ার অনেক দেশ নির্দিষ্ট সদস্যসংখ্যার ভিত্তিতে ইউনিয়ন গঠনের অনুমতি দেয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) 'বেটার ওয়ার্ক' প্রোগ্রামের তথ্যানুসারে, বিভিন্ন দেশে ৭ থেকে ২০ জন শ্রমিক একত্রিত হয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করতে পারেন।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মাশুকুর রহমান সিকদার বলেন, 'আমরা এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছি, তবে শিগগিরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।'
বাংলাদেশে একসময় ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য ৩০ শতাংশ শ্রমিকদের সমর্থন লাগত, যা পরে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। বর্তমানে দেশে ৯ হাজার ৯৩৭টি নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে, যার মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে ১ হাজার ৩৮১টি।
তবে শ্রমিক নেতারা দাবি করছেন, তৈরি পোশাক শিল্পে নিবন্ধিত ইউনিয়নগুলোর মধ্যে ১০০টিরও কম কার্যকরভাবে সক্রিয় রয়েছে এবং এর মধ্যে মাত্র ৪০টির মতো সংগঠন 'দরকষাকষির প্রতিনিধিত্বকারী' (সিবিএ) মর্যাদা ভোগ করছে।
এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে টিবিএস আইএলও'র ঢাকা অফিসে ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করলেও, এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মালিকদের শঙ্কা: বিশৃঙ্খলা ও চাপ বাড়বে
কারখানা মালিক ও শ্রম আইন বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের শর্ত এতটা সহজ করে দিলে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিনির্ভর খাত—তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
পূর্বের শ্রম আইন সংস্কারে যুক্ত অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ বলেন, 'যদি মাত্র ২০ জন শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করতে পারে এবং একটি কারখানায় পাঁচটি পর্যন্ত ইউনিয়ন অনুমোদিত হয়, তাহলে ব্যবস্থাপনা প্রতিনিয়ত দাবি-দাওয়ার চাপ কীভাবে সামাল দেবে?'
তিনি আরও বলেন, 'এতে বিভাজন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের দরজা খুলে যেতে পারে।'
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, 'আইএলও হয়তো এই পরিবর্তনের পক্ষে চাপ দিচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি শ্রমিকদের উপকারে আসবে না।'
তিনি বলেন, '৫ হাজার শ্রমিকের একটি কারখানায় যদি মাত্র ২০ জন একটি ইউনিয়ন গঠন করে দাবি তোলে, তাহলে তা শুধু উত্তেজনা ও অসন্তোষ বাড়াবে।' এসময় তিনি কম্বোডিয়ার উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে একই ধরনের সংস্কার চাপের মুখে কার্যকর হলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের (বিজিআইডব্লিউএফ) সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার সতর্ক করে বলেন, 'এই পরিবর্তনের ফলে কারখানায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়তে পারে। এতে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত হওয়ার চেয়ে বরং নতুন বিভাজন তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।'
শুধু ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, কার্যকর সিবিএ (দরকষাকষির প্রতিনিধি) ছাড়া শ্রমিকের অধিকার রক্ষা সম্ভব নয়—এমন মন্তব্য করছেন অনেক শ্রমিক নেতা ও অধিকারকর্মী।
যদিও কেউ কেউ প্রস্তাবিত পরিবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছেন, অন্যরা মনে করছেন, প্রকৃত সংস্কারের জন্য ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং নিয়মিত ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ইউনিয়নগুলো সত্যিকার অর্থে শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, 'যত সংখ্যক শ্রমিক ইচ্ছা করলে সংগঠিত হওয়ার অধিকার থাকা উচিত। আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন হলে আমরা এই উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখি।'
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপতি ও টিসিসি সদস্য তাসলিমা আখতার জানান, 'টিসিসির বৈঠকে এই প্রস্তাব উঠেছিল এবং আমরা তা সমর্থন করেছি। তবে মালিক পক্ষ এতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে।'
আন্তর্জাতিকভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শতাংশভিত্তিক শর্তকে অনুকূল হিসেবে দেখা হয় না এবং আইএলওও এটি বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যাভিত্তিক পদ্ধতির সুপারিশ করেছে। তবে অধিকারকর্মীরা বলছেন, এ ধরনের বড় পরিবর্তন আনতে হলে শ্রম আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা—বিশেষ করে নিবন্ধন ও নির্বাচন সংক্রান্ত বিধানগুলো সংশোধন করতে হবে।
বাংলাদেশ শ্রম আদালত আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম নাসিম বলেন, 'শ্রম আইনে ইউনিয়ন গঠনের পাশাপাশি নিবন্ধন বাধ্যতামূলক, না হলে তা আইনগতভাবে কার্যকর হয় না।' তিনি জানান, শ্রমিকরা ইউনিয়ন গঠনের পরেও শ্রম দপ্তরের নানা জটিলতায় নিবন্ধন পান না, বরং অনেক সময় প্রতিশোধমূলকভাবে চাকরিচ্যুত হন—যার প্রতিকার মেলে না।
এছাড়া তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের এক রায়ের ফলে শ্রম দপ্তরকে প্রতিটি ইউনিয়নের নির্বাচন তদারকি করতে হয়, কিন্তু কয়েক হাজার ইউনিয়নের নির্বাচন পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা দপ্তরের নেই।
এই সমস্যা সমাধানে শ্রম সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, শ্রম দপ্তরের সীমিত তত্ত্বাবধানে ইউনিয়নগুলোকেই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ দিতে হবে।
অ্যাডভোকেট নাসিম বলেন, 'এই সংশোধনগুলো এককভাবে কার্যকর না হলে সমন্বয়ের অভাবে সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত হবে না।'
শ্রম সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, 'শুধু বেশি সংখ্যক ইউনিয়নের অনুমতি দিলেই হবে না। কার্যকর সিবিএ নির্বাচন না থাকলে বড় ইউনিয়নও অকার্যকর হয়ে পড়ে। আবার যদি সিবিএর কাজ অন্য ইউনিয়ন দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়া অচল হয়ে পড়ে। তাই আইনে সিবিএর কাজের পরিসর স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা জরুরি।'
'কার্যকর সিবিএ না থাকলে অতিরিক্ত ইউনিয়ন বাড়িয়ে লাভ নেই'
শুধু ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, কার্যকর সিবিএ [কালেক্টিভ বার্গেনিং এজেন্ট বা দরকষাকষির প্রতিনিধি] ছাড়া শ্রমিকের অধিকার রক্ষা সম্ভব নয়—এমন মন্তব্য করছেন অনেক শ্রমিক নেতা ও অধিকারকর্মী।
যদিও কেউ কেউ প্রস্তাবিত পরিবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছেন, অন্যরা মনে করছেন, প্রকৃত সংস্কারের জন্য ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং নিয়মিত ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ইউনিয়নগুলো সত্যিকার অর্থে শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, 'শ্রমিকদের যেন যেকোনো সংখ্যায় সংগঠিত হওয়ার অধিকার থাকে, সেটি নিশ্চিত করা উচিত। প্রস্তাবটি যদি আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে আমরা তা ইতিবাচকভাবে দেখি।'
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপতি ও টিসিসি সদস্য তাসলিমা আখতার জানান, 'টিসিসির বৈঠকে এই প্রস্তাব উঠেছিল এবং আমরা তা সমর্থন করেছি। তবে মালিক পক্ষ এতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে।'
আন্তর্জাতিকভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শতাংশভিত্তিক শর্তকে অনুকূল হিসেবে দেখা হয় না এবং আইএলওও এটি বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যাভিত্তিক পদ্ধতির সুপারিশ করেছে। তবে অধিকারকর্মীরা বলছেন, এ ধরনের বড় পরিবর্তন আনতে হলে শ্রম আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা—বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন ও নির্বাচন সংক্রান্ত বিধানগুলো সংশোধন করতে হবে।
বাংলাদেশ শ্রম আদালত আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম নাসিম বলেন, 'শ্রম আইনে ইউনিয়ন গঠনের পাশাপাশি নিবন্ধন বাধ্যতামূলক, না হলে তা আইনগতভাবে কার্যকর হয় না।' তিনি জানান, শ্রমিকরা ইউনিয়ন গঠনের পরেও শ্রম দপ্তরের নানা জটিলতায় নিবন্ধন পান না, বরং অনেক সময় প্রতিশোধমূলকভাবে চাকরিচ্যুত হন—যার প্রতিকার মেলে না।
এছাড়া উচ্চ আদালতের এক রায়ের ফলে শ্রম দপ্তরকে প্রতিটি ইউনিয়নের নির্বাচন তদারকি করতে হয়, কিন্তু কয়েক হাজার ইউনিয়নের নির্বাচন পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা দপ্তরের নেই—এটাও একটা উদ্বেগ।
এই সমস্যা সমাধানে শ্রম সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, শ্রম দপ্তরের সীমিত তত্ত্বাবধানে ইউনিয়নগুলোকেই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ দিতে হবে।
টিবিএস-এর গবেষণা প্রকাশনা ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স বাংলাদেশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যাডভোকেট নাসিম বলেন, 'এই সংশোধনগুলো এককভাবে কার্যকর না হলে সমন্বয়ের অভাবে সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত হবে না।'
শ্রম সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, 'শুধু বেশি সংখ্যক ইউনিয়নের অনুমতি দিলেই হবে না। কার্যকর সিবিএ নির্বাচন না থাকলে বড় ইউনিয়নও অকার্যকর হয়ে পড়ে। আবার যদি সিবিএর কাজ অন্য ইউনিয়ন দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়া অচল হয়ে পড়ে। তাই আইনে সিবিএর কাজের পরিসর স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা জরুরি।'