আলোচনায় ধীর গতি, তবুও আশাবাদী ঐকমত্য কমিশন

প্রায় পাঁচ মাসে দুই ধাপে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ৫৫টি বৈঠক করেও মাত্র ছয়টি বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে পেরেছে জাতীয় ঐক্যমত কমিশন। নয়টি বিষয়ে নীতিগত ঐক্য হলেও এখনো আলোচনা চলছে ১০টি বিষয়ে।
এছাড়া তিনটি বিষয়ে এখনো আলোচনা শুরুই হয়নি। কিন্তু এতসব বৈঠকের মধ্যেও শাসনতন্ত্রের মৌলিক কোনো বিষয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।
তবুও আলোচনার সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ২ জুলাই তিনি বলেন, "মাঝেমধ্যে আমরা একটু এগোই, আবার কখনো প্রত্যাশামতো অগ্রগতি হয় না বলে হতাশ হই। কিন্তু আজকের দিন পর্যন্ত এসে মনে হচ্ছে, জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে আমরা একটি সনদের দিকে এগোতে পারব।"
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দলীয়, জোটগত এবং ব্যক্তিগতভাবে কমিশনের সঙ্গে বিগত কয়েকদিনে যেসব আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়েছে, তা আশাবাদের জায়গা তৈরি করেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, এক ধরনের সমঝোতার দিকে এগোনোর সম্ভাবনা আছে।
আলী রীয়াজ বলেন, "আমরা হয়তো প্রতিদিন অর্জন করছি না, কিন্তু কিছু কিছু অর্জন হচ্ছে। পরস্পরকে জানছি, কাঠামোগুলো বিবেচনা করছি। সফলতার জন্য চেষ্টা করছি, সেটাই আমাদের আশাবাদী করে তুলছে।"
ঐক্যমত কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ধাপে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশন এবং দ্বিতীয় ধাপে ৯ জুলাই পর্যন্ত ১০টি সমষ্টিক অধিবেশনে প্রায় ১৭টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। চূড়ান্তভাবে যেসব বিষয়ে আলোচনা নিষ্পত্তি হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ এবং উপজেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালতের সম্প্রসারণ।
নীতিগত ঐক্যমত এসেছে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন, নিম্নকক্ষে নারী আসন ৫০ থেকে ১০০-তে বৃদ্ধি, উচ্চকক্ষে ১০০ সদস্যের কাঠামো, জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান সংশোধন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গোপন ব্যালট ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার যুক্তকরণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার এবং বিএনপির শর্তসাপেক্ষে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ে।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা এখনো শুরু হয়নি। সেগুলো হলো সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া, স্থানীয় সরকারে নারীর প্রতিনিধিত্ব এবং জেলা সমন্বয় পরিষদ গঠন।
এছাড়া বর্তমানে চলমান আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি, উচ্চকক্ষের কাঠামো ও কার্যাবলী, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া, এনসিসি বা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ও তার ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, রাষ্ট্রের মূলনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো ও প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার।
এদিকে আলোচনার অগ্রগতিকে অনেকে সন্তুষ্টির দৃষ্টিতে দেখলেও, কেউ কেউ হতাশাও প্রকাশ করেছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, "অনেক রাজনৈতিক দল ভাবছে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে কাঠামো নিজেদের মতো করে নিতে পারবে। এর ফলে একটি জনগণবিচ্ছিন্ন ক্ষমতা কাঠামো তৈরি হবে। আমরা বলতে চাই, সেটি কখনো স্থায়ী হবে না।"
তিনি আরও বলেন, অতীতে রাষ্ট্রকাঠামোয় যে ত্রুটি ছিল, তার ফলেই আজ আমাদের এই পরিস্থিতিতে বসতে হচ্ছে। যদি সেই কাঠামো ঠিক থাকত, তবে গণ–অভ্যুত্থান হতো না। যারা আলোচনায় অনড় অবস্থান ধরে রাখছেন, তারা বাস্তব পরিস্থিতিকে আমলে নিচ্ছেন না।
আমার বাংলাদেশ পার্টির আহ্বায়ক মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, "আলোচনার পরিবেশ ভালো, খাওয়াদাওয়া ভালো হচ্ছে, কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এনসিসি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো ঐক্যমত হচ্ছে না। জনগণ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, বিপুল রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু ফলাফল মিলছে না। বড় দলগুলোর দায়িত্ব বেশি, তাদের ত্যাগও বেশি হওয়া উচিত। তারা যদি প্রকৃত পরিবর্তন না চায়, তাহলে কিছুই বদলাবে না।"
গত ২২ জুনের এক বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আজাদ। তিনি বলেন, "দলীয় অবস্থান আমরা জানাতে পারছি ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসছে না। আমরা একবার এগোই, আবার তিনবার পিছিয়ে যাই। ভালো আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু কোনো কনক্লুশন নেই। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সনদ তৈরি করতে চাইলে আলোচনা নির্ধারিত এজেন্ডাভিত্তিক হওয়া উচিত।"
এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, "অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সংস্কার নিয়ে ৯০ শতাংশ প্রস্তাবে বিএনপি একমত হয়েছে। জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র ও জনগণের স্বার্থে আমরা অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়েছি। তবে জনগণের ইচ্ছা, গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কোনো বিষয়ে ছাড় দেওয়া হবে আত্মঘাতী। দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এবং আমরা আশা করি ঐক্যমত কমিশন তা-ই করবে।"