তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে ভিন্ন প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশন–রাজনৈতিক দলগুলোর

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, গঠন প্রক্রিয়া ও দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলো ও জাতীয় ঐক্যমত কমিশন ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাবনা দিয়েছে।
গত ১০ জুন জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের এক বৈঠকে এ সংক্রান্ত দুটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। পরে, ১৩ জুলাই কমিশন দুটি প্রস্তাব একীভূত করে 'নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি' গঠনের একটি নতুন প্রস্তাব দেয়। এতে কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৩ জন নির্ধারণ করা হয়।
এর আগে, কমিশনের বিকল্প প্রস্তাব-২–এ সাত সদস্যের কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল। আর বিকল্প প্রস্তাব-১–এ উল্লেখ ছিল যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে সর্বদলীয় ন্যূনতম আট সদস্যের একটি কমিটি থাকবে, যারা 'র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং' পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন।
অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন সংক্রান্ত পৃথক পৃথক প্রস্তাবনা দিয়েছে। বিএনপি ছয়টি, জামায়াত তিনটি ও এনসিপি দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে।
এই প্রস্তাবনাগুলো পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পাকিস্তানে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে কিছুটা মিল থাকলেও বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।
কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে বিচার বিভাগ (জুডিশিয়ারি) কিংবা রাষ্ট্রপতিকে কোনো পক্ষ হিসেবে রাখা হবে না। পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে একাধিক বিকল্প পথ রাখার প্রস্তাবেও দলগুলো সম্মতি দিয়েছে।
জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, "সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃস্থাপন করা হলে ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে গণভোটের প্রয়োজন হবে।"
তিনি আরও বলেন, "তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য নেই। এজন্য ভবিষ্যতে জনগণের মতামত ছাড়া এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন যেন না আসে, সে উদ্দেশ্যেই গণভোটের বিধান সংযোজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।"
মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের ১৪তম দিনের বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
আলী রীয়াজ আশা প্রকাশ করেন, "আগামী সপ্তাহের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।"
তিনি আরও জানান, "সংবিধানের প্রস্তাবনা, রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি, ৪৮, ৫৬, ১৪২ ধারা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত ৫৮(বি), ৫৮(সি), ৫৮(ডি) ও ৫৮(ই) ধারাসমূহ সংশোধন করতে হলেও গণভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় গ্রহণ করতে হবে।"
কমিশনের বর্তমান প্রস্তাব
জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সাম্প্রতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংসদ যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয়, তবে সংবিধানের ৫৮(খ) ধারা সংশোধন করে একটি ১৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করা হবে।
এই কমিটিতে নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের সরকার ও বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত একজন সদস্য থাকবেন।
কমিটি গঠনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উপদেষ্টা নির্বাচনে সমঝোতা না হলে, সরকারি ও বিরোধী দল পৃথকভাবে পাঁচজন করে এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল চারজন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবে। এরপর সংসদে শুনানি শেষে একে অপরের তালিকা থেকে প্রার্থী বাছাই করা হবে। যদি কোনো অভিন্ন প্রার্থী পাওয়া যায়, তাকেই প্রধান উপদেষ্টা করা হবে। না হলে ক্রমভিত্তিক ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে।
প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে পূর্বের ভোটিং তালিকা অনুসারে পরবর্তী প্রার্থীকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। প্রয়োজনে তৃতীয় স্থানে থাকা ব্যক্তিকেও নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
পাকিস্তান মডেলের সঙ্গে মিল-অমিল
পাকিস্তানের সংবিধানের ২২৪ ধারায় বলা হয়েছে, কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী প্রথমে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতার মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। এতে সমঝোতা না হলে, স্পিকারের নেতৃত্বে সরকারি ও বিরোধী দলের সমান প্রতিনিধিত্বে গঠিত আট সদস্যের একটি কমিটি বিষয়টি নির্ধারণ করবে।
এই কমিটিও তিন দিনের মধ্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারলে, দুইজন প্রার্থীর নামসহ প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হবে। এরপর নির্বাচন কমিশন দুই দিনের মধ্যে একজনকে কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চূড়ান্ত করবে।
বিএনপির প্রস্তাবনা
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে বিচার বিভাগের সম্পৃক্ততা এড়িয়ে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে।
১৩ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "আগের সংবিধানের ৫৮(ক), ৫৮(খ), ৫৮(গ) ধারা ছিল সম্পূর্ণ বিচার বিভাগের ওপর নির্ভরশীল। এবার বিচার বিভাগকে বিতর্কের বাইরে রাখতে হলে নতুন কিছু বিকল্প দরকার।"
বিএনপির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার ৩০ দিন আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একজন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেবেন। সমঝোতা না হলে, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার ও বিরোধী দলের ডেপুটি স্পিকার বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। রাষ্ট্রপতি বা স্পিকার এতে সভাপতিত্ব করতে পারবেন, তবে রাষ্ট্রপতির ভোটাধিকার থাকবে না।
এরপরেও ঐকমত্য না হলে, ওই চারজনের সঙ্গে সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজনকে যুক্ত করে আলোচনা হবে। তাতেও সিদ্ধান্ত না হলে, অন্তত ৫ শতাংশ ভোট পাওয়া দলগুলোর একজনকে নিয়ে পরবর্তী আলোচনায় রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করবেন এবং এবার তিনি ভোটাধিকারসহ থাকবেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "এই প্রক্রিয়াতেও সমাধান না এলে, আমরা ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় ফিরে যেতে পারি। তখন ৭৫ বছরের কম বয়সী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার ও বিরোধী ডেপুটি স্পিকার চারজন মিলে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাছাই করবেন।"
তিনি আরও বলেন, "তারপরেও যদি উপযুক্ত কেউ না পাওয়া যায়, তাহলে রাষ্ট্রপতিকে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। অথবা রাষ্ট্রপতিকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের প্রধানকেও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।"
পাকিস্তানের মতো কেয়ারটেকার সরকারে সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে প্রধান করার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, "এটা এখন বলা যাচ্ছে না। এটি আলোচনার বিষয়। যদি দলগুলো একমত হয়, তাহলে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হবে।"
তিনি যোগ করেন, "আলোচনা এখনো চলছে এবং উন্মুক্ত রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমেই একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।"
জামায়াতে ইসলামীর ৩ প্রস্তাবনা
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলের মতে, জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ থেকে ৩০ দিন আগে অথবা সংসদ ভেঙে গেলে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে হবে।
প্রথম প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা মিলে একটি কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতিত্ব করবেন প্রধান বিচারপতি। এই কমিটি গঠনের তিন দিনের মধ্যে সরকারি জোট ও প্রধান বিরোধী জোট পাঁচজন করে এবং অন্যান্য বিরোধী দল দুটি করে নির্দলীয় প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবে। আলোচনার মাধ্যমে কমিটি একজনকে বেছে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। রাষ্ট্রপতি সংসদের মেয়াদ শেষে তাকে ১২০ দিনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ বা ৩০ দিন আগে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং সংসদ সচিবালয়ের মাধ্যমে ১০ সদস্যের একটি 'নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি' গঠিত হবে। কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধী দলের ডেপুটি স্পিকার, উপনেতা, প্রধান হুইপ, বিরোধী উপনেতা, বিরোধী প্রধান হুইপ এবং অন্যান্য বিরোধী দলের দুইজন প্রতিনিধি। কমিটির সভাপতি হবেন স্পিকার।
কমিটি যদি তিন দিনের মধ্যে সিদ্ধান্তে না পৌঁছায়, তবে সরকারি দল পাঁচজন, প্রধান বিরোধী দল পাঁচজন এবং অন্যান্য বিরোধী দল তিনজনসহ মোট ১৩ জন নির্দলীয় প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবে। সেখান থেকে কমিটি একজনকে বেছে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে এবং রাষ্ট্রপতি তাকে ১২০ দিনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
তৃতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ওপরের দুটি প্রস্তাবে সমঝোতা না হলে, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহাল করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। তবে সেখানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা রাখার বিধান বাদ দিতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে সংসদীয় পদ্ধতি চায় এনসিপি
নির্বাচনী সহায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ সংসদের মাধ্যমেই করতে চায় এনসিপি। দলের প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদ ভাঙার অন্তত তিন সপ্তাহ আগে ১১ সদস্যের একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন করতে হবে। সংসদে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে কমিটিতে দলসমূহের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, তবে কোনো দলকে অন্তর্ভুক্তির জন্য অন্তত ৫ শতাংশ ভোট পেতে হবে।
সরকারি দল, প্রধান বিরোধী দল এবং অন্যান্য বিরোধী দল তিনজন করে মোট ৯ জন নির্দলীয় প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবে, যাদের মধ্যে থেকে একজনকে নির্বাচন করা হবে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। কোন দল কোন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করেছে, তা প্রকাশ্যে জনসাধারণকে জানাতে হবে। এরপর সব নাম পাঠানো হবে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির কাছে। কমিটি ৮-৩ ভোটে একজনকে চূড়ান্ত করবে।
এনসিপির দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত না এলে, সংসদের উচ্চকক্ষ 'র্যাংকড চয়েস' পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচন করবে।