দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চাকরি খুঁজছেন ২৯ শতাংশ তরুণ

বাংলাদেশে তরুণদের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে চাকরির খোঁজে থাকলেও সফল হতে পারছেন না। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ২৯ শতাংশ তরুণ টানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি খুঁজছেন।
আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলো, গত এক বছরে অন্তত একবার চাকরির জন্য আবেদন করা তরুণদের মধ্যে ৪৫ শতাংশই কোনো ইন্টারভিউয়ের (চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার) ডাক পাননি। এতে চাকরিবাজারের বাস্তবতার সঙ্গে প্রার্থীদের এক গভীর বিচ্ছিন্নতার চিত্র উঠে এসেছে।
গতকাল ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'ইয়ুথ ইন ট্রানজিশন: নেভিগেটিং জবস, এডুকেশন, এন্ড চেঞ্জিং পলিটিকাল সিনারিও পোস্ট জুলাই মুভমেন্ট' শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এ জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় 'ইয়ুথ সার্ভে ২০২৫: ট্র্যাকিং পারসেপশন্স অন রিফর্মস, স্কিলস, জবস অ্যান্ড এডুকেশন' শীর্ষক জরিপটি পরিচালনা করে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।
জরিপে তরুণদের প্রস্তুতি ও চ্যালেঞ্জের এক উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গত এক বছরে মাত্র ১২ শতাংশ তরুণ কোনো ধরনের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে কম্পিউটার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৪৯ শতাংশ।
চাকরিবাজার নিয়ে তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় অপ্রস্তুতির অনুভূতি রয়েছে। মাত্র ১৫ শতাংশ তরুণ মনে করেন, তাদের শিক্ষা জীবন তাদেরকে চাকরির জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত করতে পেরেছে। বিপরীতে, ৩১ শতাংশের মতে, তাদের পড়াশোনার সঙ্গে চাকরির প্রস্তুতির কোনো সম্পর্কই ছিল না।
পেশাগত আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে দেখা গেছে, এখনো সরকারি চাকরি তরুণদের পছন্দের শীর্ষে—৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা সরকারি খাতে কাজ করতে চান। এরপরেই আছে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ—২৬ শতাংশ তরুণ নিজের উদ্যোগ গড়ে তোলার ইচ্ছা জানিয়েছেন।
জরিপে লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সরকারি চাকরির প্রতি নারীদের আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি—৪২ শতাংশ নারী উত্তরদাতা এই খাতে কাজ করতে আগ্রহী, যেখানে পুরুষদের মধ্যে এই হার ৩৩ শতাংশ।
জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণদের মধ্যে ১.৭ শতাংশ ইতোমধ্যে বিদেশে কাজ করে দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে ৭৩ শতাংশই আবার বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে, যারা কখনো বিদেশে যাননি, তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ বিদেশে কাজ করতে আগ্রহী; তবে ৫৭ শতাংশ দেশে থেকেই কাজ করতে চান।
দেশে থাকার পক্ষপাতী তরুণদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি—এই শ্রেণিতে নারীর হার ৭১ শতাংশ, আর পুরুষের হার ৪৬ শতাংশ। যারা বিদেশে কাজ করতে আগ্রহী, তাদের প্রধান প্রেরণা হলো—উচ্চ বেতন, উন্নত সুযোগ-সুবিধা এবং জীবনমান।
জরিপে গিগ ইকোনমির বিষয়টিও উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ৪২ শতাংশ তরুণ ফ্রিল্যান্সিং বা গিগভিত্তিক কাজ সম্পর্কে জানেন না। অপরদিকে, মাত্র ১০ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা বিষয়টির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত।
তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি আগ্রহের প্রধান কারণ হিসেবে ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা 'বাসা থেকে কাজের সুযোগ' এবং 'কাজের নমনীয়তা'কে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ৫৯ শতাংশ মনে করেন, স্থানীয় চাকরির চেয়ে ফ্রিল্যান্সিং করেই বেশি আয় করা যায়।
চাকরির ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঘুষ-তদবির বা স্বজনপ্রীতিকেই সবচেয়ে বেশি চিহ্নিত করেছেন ৫৫ শতাংশ তরুণ। অন্যান্য বড় বাধার মধ্যে রয়েছে—প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি (৫৩ শতাংশ), চাকরির অভাব (৫০ শতাংশ) এবং সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে চাকরিবাজারের চাহিদার অসামঞ্জস্য (৪৯ শতাংশ)।
প্রতিবেদনে উঠে আসা কিছু কেস স্টাডি পরিসংখ্যানটিকে আরও বাস্তবভিত্তিক করে তুলেছে। জরিপে মাস্টার্স পাশ করা একজন উত্তরদাতা—যিনি পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক এবং একজন সিঙ্গেল মাদার (একক মা)—মাসে মাত্র ৫ হাজার টাকারও কম আয় করেন বলে জানিয়েছেন।
আরেকজন, ঝালকাঠির ৩০ বছর বয়সী একজন ফ্রিল্যান্সার। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ধারণা থেকে তিনি চাকরির জন্য আবেদন করাই বন্ধ করে দিয়েছেন। তার বিশ্বাস, যোগ্য হলেও তাকে কখনো বিবেচনা করা হবে না।