বিতর্কিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের দেওয়া রায়ে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে সরকার

গত বছরের ঈদুল আজহার আগে ছেলের ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন মতিউর রহমান। অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি কর ফাঁকির মামলায় ব্যবসায়ীদের পক্ষে রায় দিয়েছেন, যার ফলে সরকার প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজস্ব বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ফাঁকি দেওয়া শুল্ক ও ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করার জন্য। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের অভিযোগ, ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ জুন ২০২৪ পর্যন্ত মাত্র চার মাসের স্বল্পমেয়াদি দায়িত্বকালীন সময়ে ট্রাইব্যুনালের প্রধান হিসেবে মতিউর রহমান—নিয়মিতভাবে বড় অঙ্কের শুল্ক ও কর ফাঁকির অভিযোগে অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর পক্ষে রায় দিয়ে, ঠিক এর উল্টো কাজ করেছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, মতিউর এই দায়িত্বে থাকাকালীন কাস্টমস ও ভ্যাটসংক্রান্ত মোট ২৭০টি আপিল নিষ্পত্তি করে রায় দেন, যার মধ্যে সরকারের বিপক্ষেই দেন ৮৪ টি রায়। এতে সরকারের আনুমানিক ১,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান নিশ্চিত করেছেন যে, এসব মামলা থেকে যদি কোনো অবৈধ সুযোগ নিয়ে থাকে মতিউর রহমান, সেটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে দেখছে। তারা মামলাও করেছে, তাদের তদন্তে ডিটেইলস উঠে আসবে বলেও জানান তিনি।
হাইকোর্টে বিচারাধীন ও দুদকের তদন্ত
ইতোমেধ্যে মতিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন আপিল ট্রাইব্যুনালের ২১টি রায় চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। যেগুলোর সাথে সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব দাবি জড়িত। হাইকোর্টের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট সংক্রান্ত বেঞ্চে এনবিআর ও সরকারের পক্ষে রিটগুলো সম্প্রতি ফাইল করেছে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস; যেখানে বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষে 'অস্বাভাবিকভাবে' দেওয়া এসব রায়কে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
দুদক ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মতিউর ওইসব কোম্পানি থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে তাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে। 'ফলে এনবিআরের অনুরোধে ওইসব রায় চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে,' বলে জানায় অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের একটি সূত্র।
এদিকে প্রায় হাজার কোটি টাকার জ্ঞাত আয়-বহির্ভুত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মতিউরসহ তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চারটি পৃথক মামলা করেছে দুদক। এসব মামলা এখন তদন্তাধীন। মতিউর ও তার প্রথম স্ত্রী এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
এই মামলাগুলোর একজন তদন্ত কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, মতিউর রহমান এনবিআরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত থাকাকালীন—বিশেষত বিভিন্ন বন্দরে কাস্টমস কমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে, অবৈধ উপায়ে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক সদস্যও বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, এনবিআরের অভ্যন্তরীণ তদন্তে মতিউরের ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রভাব খাটানোর স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।
ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মামলা ও বিতর্কিত রায়
মতিউরের বিতর্কিত রায়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি হলো গত ১২ জুন ২০২৪ তারিখে দেওয়া একটি রায়। সেখানে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একটি স্টিল কোম্পানির কাস্টমস ফাঁকির মামলায় তিনি ওই কোম্পানির পক্ষে রায় দেন।
কোম্পানিটি আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম দামে (প্রতি কেজি ৩.৬৭ ডলার দরে) ৫৭,০০০ কেজি কেমিক্যাল আমদানি দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেয়। এই কাঁচামালের প্রকৃত বাজারদর ৪ কোটি ৬৭ লাখ ১৭ হাজার ২00 টাকা হলেও—দেখানো হয় মাত্র ২ কোটি ৫১ লাখ ২ হাজার ৮00 টাকা। যার ফলে তাদের কম শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এই কর ফাঁকি ধরা পড়লেও চট্টগ্রাম কাস্টমস চালানটিকে ছেড়ে দেয়, এবং বলে তাদের মূল্য সংক্রান্ত ঘোষণা সঠিক ছিল।
এরপর যখন চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ওই ছাড়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মতিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আপিল করলে, ২০২৪ সালের ১২ জুন এক রায়ে সেই আপিল খারিজ করে রায় দেয় মতিউর রহমান। এর ফলে, সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ঘোষণা করা কম দামের (আন্ডার-ইনভয়েস) মূল্যই কার্যকর থাকে। এ অবস্থায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে ট্রাইব্যুনালের ওই রায় বাতিলের আবেদন জানায়। ট্রাইব্যুনালের ওই রায় কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না—ইতোমধ্যে এক আদেশে জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।
রাষ্ট্রপক্ষে এই রিট পরিচালনা করছেন, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জামিউল হক ফয়সাল। তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও ট্রাইব্যুনালকে এ বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে এবং মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ সুত্রে জানা যায়, মতিউরকে গত বছরে ২৩ জুন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তার আগে ১২ ও ১১ জুন, ওই একই ইস্পাত কোম্পানির করফাঁকির অন্তত পাঁচটি অভিযোগে চট্টগ্রাম ও মংলা কাস্টমসের দায়ের করা আপিল খারিজ করে দেন মতিউর। সেগুলো চ্যালেঞ্জ করেও হাইকোর্টে রিট হয়েছে।
আরেকটি ক্ষেত্রে, একটি কেমিক্যাল কোম্পানি কাঁচমাল আমদানিতে ২০২৩ সাল কয়েক দফায় প্রায় ৭ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়। এসংক্রান্ত আপিলে সরকারে বিপক্ষে রায় দেন মতিউর। সেটিও হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
মতিউরের বিরুদ্ধে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগ
মতিউর রহমানের ছেলে কোরবানির জন্য ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনার চেষ্টা করেছিলেন, যাকে কেন্দ্র করে সেই "ছাগলকাণ্ড" দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়, এবং তখনই সাবেক এই কর্মকর্তার বিপুল সম্পদের প্রসঙ্গ সামনে আসতে থাকে।
গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসে, মতিউর রহমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে বিপুলসংখ্যক সম্পত্তি; যার মধ্যে রয়েছে জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, কারখানা, বিলাসবহুল বাড়ি এবং বিনোদন পার্ক ও রিসোর্টও আছে। তাঁর নিজ জেলা বরিশাল থেকে শুরু করে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী এবং ফেনীর বিভিন্ন স্থানে এসব সম্পদ রয়েছে। এসব সম্পত্তির কিছু মতিউরের নিজ নামে থাকলেও—সিংহভাগই রয়েছে তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি, ছেলে, মেয়ে এবং বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের নামে।
নরসিংদীর রায়পুরে রয়েছে, ১৫ বিঘা জমিতে তার প্রথম স্ত্রীর মালিকানাধীন 'ওয়ান্ডার পার্ক' নামক একটি বিনোদন পার্ক। এছাড়া এছাড়া, 'আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পট' নামে ৬০ বিঘা জমিতে একটি রিসোর্ট রয়েছে, যা মতিউর রহমান ও তার স্ত্রীর যৌথ মালিকানাধীন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই রিসোর্টে বিভিন্ন বিলাসবহুল সুবিধা রয়েছে। সূত্র আরও জানায়, মতিউর রহমান তার দুই স্ত্রী ও তাদের পরিবারের জন্য আলাদা দুটি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
শেয়ারবাজারে "ম্যাজিক" ও ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের অভিযোগ
পুঁজিবাজারেও মতিউরের ব্যাপক বিনিয়োগের তথ্য সামনে এসেছে, যা তার সম্পদের বড় উৎস বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১০ সালের বাজার ধসের পরও তিনি পুঁজিবাজার থেকে বিপুল মুনাফা করেছেন বলে দাবি করেন। গত বছরে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, কীভাবে তিনি 'ফরচুন শুজ'-এর প্রি-আইপিও শেয়ারে বিনিয়োগ করে কয়েক বছরে ছয় গুণ মুনাফা করেছেন, যা বিশ্লেষকদের মতে, তার পরিবারের জন্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকার সম্পদ সৃষ্টি করেছে।