চট্টগ্রাম কাস্টমসে হয়রানির অভিযোগ কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানিকারকদের

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানিকারকরা। তাদের দাবি, কাস্টমস কর্মকর্তারা যন্ত্রপাতি মূল্যায়নে বিলম্ব করার পাশাপাশি একক সিস্টেমকে আলাদা যন্ত্রাংশ হিসেবে বিবেচনা করে শুল্ক বাড়িয়ে দিচ্ছেন, এতে 'খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহেও দেরি' হচ্ছে।
শেরপা পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড গত ১৭ জুন অস্ট্রিয়া থেকে বিএডিসির একটি প্রকল্পের আওতায় সেন্টার পিভট ইরিগেশন (সিপিআই) সিস্টেম আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু তাহের শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "প্রত্যাশিত শুল্ক ছিল প্রায় ১২ লাখ টাকা, কিন্তু কাস্টমস প্রায় ৪২ লাখ টাকা দাবি করছে, কারণ তারা যন্ত্রাংশগুলোকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করছে এবং জরিমানা আরোপ করছে।"
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, সিপিআই সিস্টেমটি একটি একক কার্যকরী সিস্টেম। এর একটি অংশ আলাদা করলে পুরো সিস্টেমটিই অকার্যকর হয়ে পড়ে। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা এর মধ্যে থাকা ৫ টন পাইপ—যা টাওয়ার ও পানি বিতরণ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত—আলাদাভাবে শুল্কায়নের চেষ্টা করছেন। এতে প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশি খরচ পড়ছে আমদানিকারকের।
আবু তাহের বলেন, "এই পাইপে হাজার হাজার ছিদ্র রয়েছে, যার মাধ্যমে বৃষ্টির মতো পানি ছিটানো হয়। অথচ কাস্টমস বলছে, এই পাইপ দিয়ে নাকি তেল বা গ্যাস সরবরাহ করা যায়। প্রশ্ন হলো, হাজারো ছিদ্রযুক্ত পাইপ দিয়ে কীভাবে তেল বা গ্যাস সরবরাহ সম্ভব?"
তিনি আরও অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা এ এইচ এম মাহবুবুর রশিদ ও ডেপুটি কমিশনার মো. সাইদুল ইসলাম সিপিআই সিস্টেমকে একক যন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তারা সিস্টেমের পাইপসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আলাদাভাবে শুল্কায়নে আগ্রহী।
আবু তাহের বলেন, "কৃষি যন্ত্রপাতি সম্পর্কে ধারণা না থাকা ব্যক্তিদের দায়িত্বে বসানোয় আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি।" তিনি কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করার আহ্বান জানান।
বিএডিসি ও শেরপা সূত্রে জানা যায়, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জে ভূ-উপরিস্থ পানিকে কাজে লাগিয়ে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নে দরপত্র আহ্বান করলে শেরপা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কার্যাদেশ পায় এবং এর অংশ হিসেবে অস্ট্রিয়া থেকে সিপিআই সিস্টেম আমদানি করে।
আবু তাহের বলেন, "প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সিপিআই যন্ত্রটিকে একক সিস্টেম হিসেবে রপ্তানি করেছে। বিএডিসির কার্যাদেশ ও বিএডিসি থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কমিশনারের কাছে পাঠানো চিঠিতেও এটি একক সিস্টেম হিসেবে বিবেচনার অনুরোধ করা হয়েছে।"
যন্ত্রটি ১৭ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমসে পৌঁছানোর পর শুল্কায়নের জন্য জমা দেওয়া হয়। নির্ধারিত শুল্ক হওয়ার কথা ছিল ১২ লাখ ৫ হাজার ৪৬৯ টাকা।
আবু তাহের বলেন, "কাস্টমস এটিকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে আখ্যায়িত করে শুল্ক ও জরিমানা মিলিয়ে ৪২ লাখ টাকা দাবি করেছে। ফলে কাস্টমসে আটকে থাকলে প্রতিমাসে আমাদের প্রায় ৪ লাখ টাকা ক্ষতি হবে।"
তিনি জানান, দেশের উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণ থেকে রক্ষায় বিএডিসি প্রথমবারের মতো সিপিআই সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে। শেরপা দীর্ঘদিন ধরে বিএডিসির সঙ্গে কৃষিখাতে কাজ করছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের সেচ ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হবে।
তবে কাস্টমসের অসহযোগিতা অব্যাহত থাকলে পুরো প্রকল্পটি ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি টিবিএসকে বলেন, "কেউ যদি পূর্ণাঙ্গ সিস্টেম আনতে চায়, তাহলে সেটিকে 'প্লান্ট' হিসেবে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে একাধিক পণ্য একটি সিস্টেমের অংশ হতে পারে। তবে তারা কোন ক্যাটাগরিতে আবেদন করেছে, সেটা আমি না দেখে কিছু বলতে পারব না। ফাইল দেখতে হবে।"
শুধু শেরপা নয়
শেরপার মতো আরও অনেক কৃষিযন্ত্র আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কাস্টমসে হয়রানি ও দেরির অভিযোগ করেছে, যা তাদেরকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলেছে।
এগ্রিকালচারাল মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন্স-বাংলাদেশ (এএমএমএ–বি)-এর প্রেসিডেন্ট এবং আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলিমুল আহসান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "প্রায় সব কৃষিযন্ত্র আমদানিকারকই এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার আনলে কাস্টমস সেটির প্রতিটি যন্ত্রাংশ আলাদা করে শুল্ক নির্ধারণ করতে চায়। অথচ একটি পার্টস না থাকলে তো পুরো যন্ত্রই অকার্যকর হয়ে পড়ে।"
তিনি আরও বলেন, "কৃষিযন্ত্র বিষয়ে অভিজ্ঞ কেউ দায়িত্বে থাকেন না। যার যা বোঝা, সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেন। ফলে অনেক উদ্যোক্তা হতাশ হয়ে পড়ছেন। অনেকেই ঋণখেলাপি হয়ে গেছেন।"
বাংলামার্ক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামও একই অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, "যেকোনো পণ্য বন্দরে পৌঁছানোর তিন দিনের মধ্যে ছাড় করতে হয়। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তারা কাগজপত্র যাচাই করতে ৭–৮ দিন, কখনো ১৫–২০ দিনও নিয়ে থাকেন। এতে প্রতিদিন বাড়তি ক্ষতি গুনতে হয়। প্রতি শিপমেন্টে ১৫–২০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়।"
তিনি জানান, ছয় মাস আগে তারা একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার আমদানি করেন, যাতে অনেকগুলো যন্ত্রাংশ ছিল। কিন্তু কাস্টমস পুরো যন্ত্র হিসেবে না দেখে আলাদা যন্ত্রাংশ হিসেবে মূল্যায়ন করে। এর ফলে শুধু একটি কনটেইনারেই তিনটি হারভেস্টারের জন্য ৯ হাজার ডলার অতিরিক্ত ক্ষতি হয়েছে।
টিবিএসের পক্ষ থেকে কৃষিযন্ত্র আমদানিকারী আরও অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।