অনিয়ন্ত্রিত, পরীক্ষাবিহীন সার ব্যবহারে মাটির স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে: বিশেষজ্ঞরা

কৃষি ও উন্নয়ন খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, বিজ্ঞানী ও মাঠপর্যায়ের কর্মীরা বাংলাদেশের মাটির স্বাস্থ্য অবনতির বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, কৃষকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ও নির্বিচারে সার ব্যবহার করায় এটি টেকসই কৃষি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
'সয়েল টু সাস্টেইনিবিলিটি: প্রমোটিং রিজেনারেটিভ অ্যাগ্রিকালচার' শীর্ষক রাউন্ডটেবিল আলোচনায় এই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। আলোচনার আয়োজন করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, হাইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। গতকাল (২৫ জুন) ঢাকার ইসকাটন গার্ডেনে টিবিএস অফিসে আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন টিবিএস সহযোগী সম্পাদক সালিম আহমেদ।
হাইফার এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে বাংলাদেশের বর্তমান মাটির অবস্থা বিশ্লেষণ করে একটি বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউট (এসআরডিআই) মহাপরিচালক বেগম সামিয়া সুলতানা বলেন, 'আমাদের কাছে উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক মাটির বিশ্লেষণ তথ্য সংরক্ষিত আছে। মাঠপর্যায়ে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে আমরা এসব তথ্য ব্যবহার করছি।'
তিনি বলেন, 'কিন্তু কৃষকেরা অনেক সময় না জেনে, না বুঝে সার প্রয়োগ করছেন। আমরা চাচ্ছি কৃষকরা যেন আমাদের ওয়েবসাইট ও ইউনিয়ন সহায়কাদের মাধ্যমে সঠিক তথ্য নিয়ে কাজ করেন।'
সামিয়া সুলতানা আরো বলেন, 'কোন ফসলে কোন জাতের জন্য কী পরিমাণ সার লাগবে—সেই বিষয়ে জেনে তারপর যেন কৃষকরা চাষ করেন, সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। আমরা সবসময় কৃষকের পাশে আছি।'
তিনি আরও জানান, এসআরডিআই ২৪টি স্থায়ী ও ১০টি মোবাইল সয়েল টেস্টিং ল্যাব পরিচালনা করে এবং অনলাইনে সার সুপারিশ সিস্টেমও চালু করেছে, যা জমির ধরণ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট সার ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়।
মাটির অবনতি, কৃষকের ক্ষমতায়ন ও অনিয়ন্ত্রিত সার ব্যবহার
হাইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর নূরুন নাহার বলেন, কৃষকের আয়, খাদ্যের নিরাপত্তা—সবকিছুই মাটির ওপর নির্ভরশীল।
তিনি বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরে মাটিকে অবহেলা করেছি—অতিরিক্ত কীটনাশক, রাসায়নিক সার, অবৈজ্ঞানিক চাষাবাদ—সবকিছুর ফল আমরা এখন ভোগ করছি।'
নূরুন নাহার আরো বলেন, 'খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, এমনকি মানব ও প্রাণীর স্বাস্থ্যের সাথেও মাটির স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এখন সময় এসেছে মাটির প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার।'
তিনি সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, বেসরকারি সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়, উন্নয়ন সহযোগী ও গণমাধ্যমকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান, যেন মাটি সংরক্ষণের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গড়ে ওঠে।
গ্রামীণ ইউগ্লেনা-এর হেড অব অপারেশন মো. নাজমুস শায়দুত নাহীদ বলেন, 'আমরা পিপিপি মডেলে জাপানে কৃষিপণ্য রপ্তানি করছি, যেখানে ফুড সেফটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। মাটিকে অবহেলা করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।।'
তিনি বলেন, 'আজও কৃষক নিজে তার উৎপাদনের দাম ঠিক করতে পারেন না, বরং ফরিয়া বা ট্রেডারের ওপর নির্ভর করেন। অথচ উন্নত দেশগুলোতে ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন নিজেরাই মূল্য নির্ধারণ করে। তাই আমাদের এখানে কৃষক সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।'
এসআরডিআই-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মামুনুর রহমান বলেন, 'প্রতিবছর কৃষিজমি কমে যাচ্ছে—গৃহায়ন, রাস্তা, শিল্পায়নের চাপে। এটা প্রথমে বন্ধ করতে হবে, কৃষি জমি রক্ষা করতে হবে। কৃষি জমি না থাকলে যতই আমরা মাটির স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি, কোনো লাভ হবে না।'
তিনি উল্লেখ করেন, কৃষকরা প্রধানত ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি এই তিন ধরনের সার ব্যবহার করেন, যা প্রায়শই অনুমানের ভিত্তিতে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'তারা মনে করেন, বেশি সার দিলে ফলন বেশি হবে। কিন্তু মাটি পরীক্ষা না করে এসব সার প্রয়োগ করলে মাটির স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাটির প্রতি যত্ন না নিলে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।'
যশোরের কৃষক শ্যামল বিশ্বাস জানান, হাইফারের সহায়তায় এসআরডিআই থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তার চাষাবাদের পদ্ধতি বদলে গেছে। তিনি বলেন, '২০ বছর ধরে আমি কৃষি কাজ করেছি। আগে না বুঝেই সার দিতাম, এখন মাটি পরীক্ষা করে সঠিকভাবে ব্যবহার করি। এতে খরচ কমেছে, ফলন বেড়েছে।'
তিনি জানান, এলাকাবাসী এখন তাকে 'মাটির ডাক্তার' নামে ডাকে।
পুনর্জীবিত কৃষির জন্য সুপারিশসমূহ
আলোচনায় উপস্থিত অনেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সার বিক্রেতাদের সনদ প্রদানের, কৃষকদের পারফরমেন্স ভিত্তিক সম্মাননা প্রদানের এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সার্ভিস সেন্টার বাড়ানোর পরামর্শ দেন। এছাড়া, অর্গানিক চাষ ও ভার্মিকম্পোস্টিংয়ের জন্য ভর্তুকি দেওয়ার সুপারিশও উঠে আসে।
শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসহাক 'এক্সপ্লোরিং দ্য সয়েল হেলথ কন্ডিশনস ইন প্রমোটিং রিজেনারেটিভ অ্যাগ্রিকালচার ইন যশোর অফ বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন।
ড. ইসহাক বলেন, 'আমাদের গবেষণার আলোকে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরেছি, যা টেকসই কৃষি চর্চা ও মাটির স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। মাল্টি-স্টেকহোল্ডার কোলাবোরেশন অর্থাৎ সরকারি, বেসরকারি ও অন্যান্য অংশীজনদের সমন্বিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। একক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়—সমন্বিত প্রচেষ্টা এই ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে জরুরি।'
তিনি দক্ষ কৃষি উদ্যোক্তা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'সেরা চাষাবাদ পদ্ধতি' বা 'মাটি স্বাস্থ্য চ্যাম্পিয়ন' জাতীয় পুরস্কার দিয়ে সেরা কাজগুলোকে উৎসাহিত করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, মাঠ পর্যায়ে কর্মীসংখ্যাও বাড়াতে হবে। কৃষকদের পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি গ্রহণে সফট লোন এবং আর্থিক সহায়তা দেয়া যেতে পারে।
টিবিএস সহযোগী সম্পাদক সালিম আহমেদ সমাপনী বক্তব্যে বলেন, 'মাটি শুধু খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়; এটি পানি সংরক্ষণ করে, কোটি কোটি জীবের বাসস্থান এবং প্রধান কার্বন সিংক হিসেবে কাজ করে। ইতিহাস প্রমাণ করে, যারা তাদের মাটির সুরক্ষা করেছে তারা টিকে আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের খাবারের ৯৫ শতাংশই আসে মাটি থেকে, অথচ প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ২৪ বিলিয়ন টন উর্বর মাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, পুনর্জীবিত কৃষি শুধু টেকসই নয়, এটি বিপ্লব। এটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, রাসায়নিক ব্যবহার কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।'
অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন রয়েল ডেনিশ দূতাবাসের ট্রেড অ্যাডভাইজার সাকিব এমএমআই চৌধুরী; জাগরনী চক্র ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক পলাশ কুমার কুণ্ডু এবং কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম।