অর্থসংকটে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা প্রকল্প থেকে বাদ ১২টি সিল্টট্র্যাপ

পাহাড়-টিলার শহর চট্টগ্রামে বর্ষা এলেই খাল-নালায় পলি জমে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। সেই পলি-মাটি শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে যায় কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে। এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৭টি সিল্টট্র্যাপ (বালু আটকানোর ফাঁদ) নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ব্যয় সংকোচনের কারণে এর মধ্যে ১২টি বাদ দিতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
এতে প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি সুফল নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন অনিশ্চয়তা। পাশাপাশি কর্ণফুলীর প্রবাহ ও চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্যতায় নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাও করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
মূলত প্রকল্পটির বর্ধিত ব্যয়ের কিছু অংশ সিডিএকে বহন করতে বলেছে সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়। সংস্থাটির সামর্থ্য না থাকায় ব্যয় সংকোচনে উপায় বেছে নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের নথিপত্রের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টিকে ঘিরে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে অনুমোদিত প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। তবে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা হয়নি। ফলে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে নানা বিপত্তিতে পড়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
এরপর ২০১৮ সালে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা যাচাই করায় সেনাবাহিনী। এতে প্রকল্পটির নকশা ও ব্যয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ২০২৩ সালে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) এক লাফে ৩ হাজার ১০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ে। ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে ইতোমধ্যে ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
সিডিএর তথ্যমতে, প্রথমে বর্ধিত ব্যয়ের দেড় হাজার কোটি টাকা দিতে রাজি হয় সরকার। বাকি দেড় হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৭৫৩ কোটি টাকা সরকারি ঋণ ও ৭৫৩ কোটি টাকা সিডিএর নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয়ের শর্তে সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদন হয়।
তবে আর্থিক সংগতি না থাকায় ২০২৫ সালের শুরুতে প্রকল্প কাটছাঁট করার প্রস্তাব দেয় সিডিএ।
গত ২৭ মার্চ অর্থ বিভাগের চিঠিতে বলা হয়, দেড় হাজার কোটি টাকার মধ্যে সরকার আরও ৬৫০ কোটি টাকা দেবে। বাকি ৮৫৬ কোটি টাকার মধ্যে ১০৩ কোটি টাকা সরকারি ঋণ এবং বাকি ৭৫৩ কোটি টাকা সিডিএর নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করতে হবে।
তবে সিডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটির আয় ও ব্যয় প্রায় সমান। তাদের এত টাকা ব্যয়ের সামর্থ্য নেই।
সিডিএর বাজেট বইয়ের তথ্যমতে, সংস্থাটির আয়ের মূল উৎস দোকানভাড়া, সঞ্চয় তহবিল থেকে পাওয়া সুদ, ভবন নির্মাণ অনুমোদন ফি, প্লট-ফ্ল্যাট ও দোকান হস্তান্তর ফি, প্লট-ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ৪৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা মোট পরিচালন ব্যয় ৩৭ দশমিক ৮০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটে রাজস্ব আয় ৫৯ দশমিক ৯১ কোটি টাকার বিপরীতে ৫২ দশমিক ৭২ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে।
যা বাদ পড়ছে
শুধু ১২টি সিল্টট্র্যাপ নয়, গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ৮৭১ কোটি টাকার কাজ বাদ দিতে যাচ্ছে সংস্থাটি।
সিডিএর খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাদ দেওয়া কাজের মধ্যে রয়েছে- ২৮৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২টি সিলট্র্যাপ নির্মাণ, ৩৬৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন খালে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, ১৫৮ কোটি ৩২ লাখ টাকায় সড়কের পাশে থাকা নালার সম্প্রসারণ, বিদ্যমান নালা পরিষ্কার ও মেরামতে ৩১ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং ১৯ কোটি ৮৪ টাকায় নতুন নালা নির্মাণ, ১০ কোটি টাকায় খালের পাড়ে পাঁচ ফুট চওড়া ফুটপাত নির্মাণ এবং ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কবাতি স্থাপনের কাজ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষায় খাল-নালা ভরাটের অন্যতম কারণ পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানির সঙ্গে গড়িয়ে আসা পলি-মাটি। প্রয়োজনীয় সিলট্র্যাপ নির্মাণ না হলে বর্ষায় খাল-নালা ভরাট রোধ করা যাবে না। ফলে জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে না। এছাড়া নালা সংস্কার ও নতুন নালা নির্মাণ না হলে বর্ষায় জমে থাকা পানি খালে যেতে পারবে না। খালগুলোতে প্রতিরোধ দেয়াল এবং পাড়ে ফুটপাত নির্মাণ করা না হলে পুনরায় তা দখল হয়ে সংকুচিত হয়ে পড়বে। এতে পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বোর্ড সদস্য ও নগর-পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিনা হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রকল্পটির শুরু থেকেই গলদ ছিল। সিডিএর কাছে ড্রেনেজ এক্সপার্ট নেই। তারা কাজ দিয়ে দিল সেনাবাহিনীর কাছে। কোনো প্রকার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এখন আবার প্রকল্পের নকশা থেকে ১২টি সিল্টট্র্যাপ বাদ দেওয়া হচ্ছে। ২৭টির বদলে যদি কম করা হয়, তাহলে অবশ্যই প্রভাব পড়বে।'
এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, '৮৫৬ কোটি টাকা খরচের সামর্থ্য সিডিএর নেই। তাই টাকাটা সরকারি অনুদান হিসেবে পেতে প্রকল্প পুনর্গঠন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করছি, সরকার প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পুরো টাকাটা অনুদান হিসেবে বরাদ্দ দেবে। বরাদ্দ না মিললে প্রকল্পের কাজ কাটছাঁট করতে হবে।'
প্রভাব পড়বে কর্ণফুলী ও বন্দরে
চট্টগ্রাম নগরীর নালা-খালগুলো কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। বর্ষায় পাহাড় থেকে পলি-মাটি ভরে কর্ণফুলী নদীতে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়।
চট্টগ্রাম খাল ও নদী সুরক্ষা কমিটির তথ্যমতে, বর্ষাকালে চট্টগ্রাম ও আশপাশের পার্বত্য এলাকা থেকে প্রায় ১০ লাখ টন পলি কর্ণফুলী নদীতে প্রবেশ করে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, অর্থনীতি বিভাগ এবং মার্কেটিং বিভাগের এক গবেষক দল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে 'প্লাস্টিক ফ্রি রিভারস অ্যান্ড সিজ ফর সাউথ এশিয়া' প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডে গবেষণা পরিচালনা করেছে। এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে রয়েছে ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসেস (ইউএনওপিএস) ও সাউথ এশিয়া কো-অপারেটিভ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (এসএসিএপি)
গবেষণায় উঠে এসেছে, যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে চট্টগ্রাম নগরে বছরে প্রায় ৭০ হাজার ৮৩৩ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য—যা মোট উৎপাদনের প্রায় ২৭ শতাংশ—নালা, নর্দমা, খাল ও জলাশয়ে জমে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীতে ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলীর বিভিন্ন স্থানে ২ থেকে ৭ মিটার পর্যন্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তর শনাক্ত করেছে, যা নদী ড্রেজিংয়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার নৌ কমান্ডার মোহাম্মদ শামসিত তাবরীজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পাহাড়ি মাটি ও পলি জমার কারণে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের নাব্যতা সংকট তৈরি হয়। এজন্য প্রতি বছর ১৫০-২০০ কোটি টাকা ড্রেজিংয়ের পেছনে ব্যয় হয়। বর্তমানে তা ১০০ কোটি টাকার মধ্যে কমিয়ে আনার চেষ্টা রয়েছে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অধীনে যদি সিল্টট্র্যাপ কমানো হয়, তাহলে পলি-মাটি আটকানো যাবে না। এক্ষেত্রে ড্রেজিং ব্যয় কমানো কঠিন হয়ে যাবে।'
অকার্যকর তিন দশকের পুরোনো সিল্টট্র্যাপ
এদিকে ৯০-এর দশকে এরশাদ সরকারের আমলে নগরীর আগ্রাবাদের নাছিরখালে একটি সিল্টট্র্যাপ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু তিন দশক ধরে কোনো সংস্কার না করায় তা অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা নৌ কমান্ডার আই ইউ এ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, নগরীর দেওয়ানহাট থেকে বারিকবিল্ডিং পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বক্স কালভার্ট রয়েছে। এটি নাছিরখাল ও লালমাইয়াছড়া খালের সঙ্গে সংযুক্ত। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় খাল ও কালভার্টগুলো মাটি ও আবর্জনায় ভরে গেছে। চলতি বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই এগুলো কার্যকর করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই দুটি খাল ও একটি বক্স কালভার্ট সংস্কারে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।