বরিশাল রুটের বিলাসবহুল বাসে আগুন কেন লাগছে!

পদ্মা সেতু চালুর পরে দক্ষিণাঞ্চলের সড়কে আসছে নামি-দামি সব পরিবহন কোম্পানি। দুই বছর আগে যেসব রুটে নিয়মিত গাড়ি পাওয়া যেত না—সেসব রুটে স্লিপিং কোচ-ও নাম লেখাচ্ছে যাত্রী সেবায়। সৌন্দর্য আর স্বাচ্ছন্দ্য যুক্ত করে বাসগুলোর আধুনিকায়ন করছে স্থানীয় পরিবহন মালিকরা। এমনকী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে হরহামেশাই টিকেট সংকটও দেখা যায়।
ব্যবসায়িক প্রয়োজনে প্রায়ই ঢাকায় যাতায়াত করেন বরিশালের রূপাতলী এলাকার বাসিন্দা নূরুল আমিন। তারও প্রথম পছন্দ ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাসের পরে আর বিলাসবহুল গাড়িতে ওঠেননি। নূরুল আমিন বলেন, 'মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে আসছি। যতদিন বেঁচে আছি–আর কোনোদিন এসি বাসে উঠব না। প্রয়োজনে লোকাল বাসে চলাচল করব, তবু আর নাহ।'
এর পেছনের ঘটনাও লোহমর্ষক।
৬ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে গ্রিন লাইন পরিবহনে বরিশালে ফিরছিলেন নূরুল আমিন। সেদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, গৌরনদী পার হয়ে উজিরপুরের বামরাইলে আসতেই হাল্কা পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম। ভাবলাম আমার ভুল। তারপর এক-দু মিনিটের মধ্যে আরো কয়েকজন সুপারভাইজারের কাছে ঘটনা কী জানতে চাইল। সবাই যখন এনিয়ে কথা বলছি, তখন গাড়িটি রাস্তার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে সুপারভাইজার যাত্রীদের দ্রুত নেমে যেতে বললেন। তিনি জানালেন, গাড়িতে আগুন লেগেছে। ২০/২২ জন যাত্রী যারা ছিলাম সকলে আতঙ্কিত হয়ে তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়লাম।
'আমরা নেমে যাওয়ার পরে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়লো গাড়িতে। আমাদের চোখের সামনে গাড়িটি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। চালক আরেকটু দেরী করলে, আমাদের সকলকে কয়লা হয়ে যেতে হতো'- বলছিলেন তিনি।
ঢাকা-বরিশাল রুটে চলতি বছরের ৬ মার্চই কেবল নয়—এর আগেও চলন্ত বাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে গত জানুয়ারিতে বরিশাল ক্যাডেট কলেজের সামনে হানিফ পরিবহনের বাসে আগুন লাগে। যাত্রী, পরিবহন স্টাফ ও স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় সে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট রাত পৌনে ১২টার দিকে গৌরনদীর কটকস্থল এলাকায় গ্রিন লাইন পরিবহনের আরেকটি চলন্ত বাসে আগুন লাগে। ওই বাসের ১৫ জন যাত্রী নিরাপদে নেমে যেতে পারলেও—গাড়িটি পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়।

দায় এড়াচ্ছে কর্তৃপক্ষ!
চলন্ত গাড়িতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও কারণ জানতে সংশ্লিষ্ট কোন দফতর কাজ করেনি। খোদ পরিবহন কর্তৃপক্ষও ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। যেমন দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে সাধারণত তদন্ত কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স। রহস্যজনক কারণে তিনটি ঘটনার একটিতেও তদন্ত করেনি বরিশাল ফায়ার সার্ভিস। অথচ প্রতিটি ঘটনায় অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার ডিফেন্সের কর্মীরা কাজ করেছেন।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, 'বাস পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় পরিবহন কর্তৃপক্ষ তদন্তের জন্য আমাদের কাছে আবেদন করেনি। আবেদন করলে কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত করে দেখা হয়, কেন এই ঘটনা। যেহেতু তারা আবেদন করেনি, এজন্য আর তদন্ত করে দেখা যায়নি।'
মিজানুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বাসের ইঞ্জিন থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটেছে।
তবে ইঞ্জিন থেকে এভাবে গাড়িতে আগুন লাগে না বলে নিজ অভিজ্ঞতায় জানান বিআরটিসি বরিশাল ডিপোর মেকানিক শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, 'আমি ৪২ বছর ধরে গাড়ির মেকানিক হিসেবে কাজ করছি। বেয়াল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতায় কোনদিন দেখিনি ইঞ্জিন দিয়ে গাড়িতে আগুন লেগেছে। ইঞ্জিনে ত্রুটি হলে সেটি বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কখনোই আগুন লাগবে না।'
গ্রিন লাইন পরিবহনের একজন মেকানিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, 'ইঞ্জিনে যত স্পার্ক হবে—তত ইঞ্জিন ভালো চলবে। গ্রিন লাইনের ইঞ্জিন গাড়ির পেছনে থাকে। অথচ ৬ মার্চ যে গাড়িটি পুড়েছে, সেটির ভিডিওতে স্পষ্ট যে আগুন সামনের দিক দিয়ে লেগেছে।'
চলন্ত বাসে অগ্নিকাণ্ডে বিআরটিএ বরিশাল অফিসও কোন তদন্ত করেনি বলে জানিয়েছেন এর সহকারী পরিচালক খালিদ মাহমুদ। তিনি এসব বিষয়ে মোটরযান পরিদর্শকদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
চলন্ত বাসে আগুনের কারণ কী?
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে চলন্ত বাসে আগুনের তিনটি ঘটনার মধ্যে দুটি ঘটনা গৌরনদী হাইওয়ে থানা পুলিশের দায়িত্বরত এলাকায়। দুটি গ্রিন লাইনের বাস পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় এই থানার পুলিশ সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করেছেন। অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ হিসেবে হাইওয়ে থানা পুলিশ মনে করে, গাড়িগুলো নিম্নমান।
গৌরনদী হাইওয়ে থানার অফিসার্স ইনচার্জ আমিনুর রহমান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার সাথে সাথে হাইওয়ে থানা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে গিয়ে কাজ শুরু করেন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য আর আমাদের ধারণা হচ্ছে, গাড়ির সমস্যা এবং পুরাতন গাড়ি হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সেলফ স্টার্ট, ডায়নামো বা এসি গাড়ির ওয়্যারিং থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে বলে মনে করেন বিআরটিসি বরিশাল ডিপোর কারিগরি প্রধান শাহাদাৎ হোসেন। তিনি বলেন, 'ইঞ্জিন যত পুরাতন হোক তা থেকে পুরো গাড়িতে আগুন লাগা অসম্ভব। সেলফ কানেকশন লুজ থাকলে, ডায়নামো অতিরিক্ত ভোল্টেজ দিলে বা বেশি সময়ে এসি চললে ওয়্যারিং গরম হয়ে গাড়ির বডিতে আগুন লাগতে পারে।'
বিআরটিএ বরিশাল অফিসের মোটরযান পরিদর্শক সৌরভ কুমার সাহা বলেন, গ্রিন লাইন পরিবহনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরপরই আমি সেটি পরিদর্শন করি। এই গাড়িতে যান্ত্রিক কোন ত্রুটিতে আগুন লাগেনি। বাসের ড্রাইভার বা সুপারভাইজার কেউ হয়তো ধূমপান করেছে, সিগারেটের অগ্নিকণা থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
তবে তিনি স্বীকার করেন, চট্টগ্রাম রুটে যে মানের গাড়ি চলে, বরিশাল রুটে সেই মানের গাড়ি চলে না। 'আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছিল সিলেট রুট থেকে বাতিল করা বাসগুলোকে মেরামত করে বরিশাল রুটে নামানো হয়। অথচ যে গাড়িটি পুড়েছে সেটি চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত রয়েছে। গাড়িটির ফিটনেসও ছিল।'
সৌরভ কুমার সাহা বলেন, হানিফ পরিবহনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ওভারহিটের কারনে। অতিরিক্ত সময়ে চালু থাকায় ইঞ্জিন ওভারহিট হয়ে সিটে আগুন লেগেছিল। বর্তমানে অরেক গাড়ি আছে এলপিজি বা সিএনজি করে। এসব করতে গিয়ে ইলেকট্রিক কিছু ডিফল্ট থাকায় আগুন লাগে। ইদানিং হাই-কোয়ালিটি ডেকোরেশন করতে গিয়ে গাড়িতে ফোম আর আঠার ব্যবহার বেশি করে। চলন্ত অবস্থায় এসব ফোম বা আঠার সংস্পর্শে সিগারেটের অগ্নিকণা বা অন্যকোনো স্পার্ক আসলে আগুন অবশ্যই লেগে যাবে। বরিশালের ঘটনাগুলোতেও এসব ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।
যা বলছে গ্রিন লাইন কর্তৃপক্ষ
দুটি চলন্ত গাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গ্রিন লাইন পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সাত্তার বলেন, 'কোটি টাকা মূল্যের গাড়িটি পুড়ে যাওয়ার পরে এখন সেটির দাম এক লাখ টাকাও নেই। আমরা এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। কিন্তু, এগুলো নিছক দুর্ঘটনা ছিল। সৌভাগ্যবশত দক্ষ চালক থাকায় যাত্রীদের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।'
'যাত্রীদের অভিযোগ নিম্নমানের গাড়ি চালানো হয় বরিশাল রুটে' এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'শুধু বরিশাল অঞ্চলে নয়—বিভিন্ন রুটে গাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গ্রিন লাইন পরিবহনের প্রতিটি বাস ফিট এবং দক্ষ স্টাফ দিয়ে পরিচালনা করা হয়।'
পুলিশ যা বলছে
তিনটি গাড়িতে আগুন লাগার ঘটনায় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি মঞ্জুর মোর্শেদ আলম বলেন, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের মাধ্যমে আগুন লেগেছে—এর বাইরে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। পরিবহন কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ থাকবে গাড়িগুলোর যাত্রা শুরুর আগে একটু পরীক্ষা করে নিবেন কোন ত্রুটি আছে কি-না। এতে জননিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং সম্পদ নষ্ট হবে না।