ঈদের আগে ক্রেতা সঙ্কট ও দাম কম, শঙ্কায় ঢাকার গরু বিক্রেতারা

ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র একদিন। কিন্তু ঢাকার কোরবানির পশুর হাটগুলোতে এখনো ধীরগতিতে বেচাকেনা চলছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক কোরবানির পশু থাকলেও রাজধানীর ২১টি স্থায়ী ও অস্থায়ী হাটে ক্রেতার উপস্থিতি কম—এমনটাই জানিয়েছেন বিক্রেতারা। বিক্রি না-হওয়ার শঙ্কায় অনেকেই দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছেন, যাতে লোকসান এড়ানো যায়।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা থেকে গরু খামারি আবদুর রশিদ মঙ্গলবার (৩ জুন) ১০টি গরু নিয়ে ঢাকার ভাটারা পশুর হাটে আসেন। বিকেল পর্যন্ত তিনি মাত্র তিনটি গরু বিক্রি করতে পেরেছেন। এর মধ্যে দুটি গরুর ওজন ছিল ৪ থেকে সাড়ে ৪ মণ (প্রায় ১৬০–১৮০ কেজি), আর প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। অন্য একটি গরু বিক্রি করেছেন ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায়।
তিনি বলেন, 'প্রতিটি গরু প্রত্যাশার চেয়ে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে।' ফিড ও শ্রমিকের খরচ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে এ বছর, অথচ গত বছরের তুলনায় বাজারদর প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে—এই বাস্তবতার কথাই তুলে ধরেন তিনি।
মঙ্গলবার ও গতকাল রাজধানীর ভাটারা, কমলাপুর, শাহজাহানপুর ও মেরুল বাড্ডা—এই চারটি বড় হাট ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে। ক্রেতা কম, দরদাম করেও অধিকাংশ সময় বিক্রির পর্যায়ে গিয়ে থেমে যাচ্ছে।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার খামারি আবু বকর সিদ্দিক ছয়টি গরু এনেছেন, প্রতিটির ওজন প্রায় তিন মণ। কিন্তু একটি গরুও বিক্রি হয়নি। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পাঁচ মাস আগে প্রতিটি গরু ৫০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি, কোনো মোটাতাজাকরণ ওষুধ ব্যবহার করিনি। এখন লোকসান না-হওয়ার জন্য অন্তত ১ থেকে ১.২০ লাখ টাকা দরকার। কিন্তু ক্রেতারা ৮০ হাজার টাকার বেশি বলছেন না।'
তবে এবারের একটি ইতিবাচক দিক হলো, মহাসড়কে চাঁদাবাজি কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন গরু ব্যবসায়ীরা। এক ব্যবসায়ী বলেন, 'আগের বছরগুলোতে প্রতি গরুর জন্য চেকপোস্টে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হতো। এবার তা অনেকটাই কমেছে, যদিও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।'
ভোলার সদরের দক্ষিণ দিঘলদী গ্রামের খামারি কামরুল হাসান খোকন জানান, এবারে কোরবানির জন্য তিনি ৩৮টি গরু প্রস্তুত করেছেন। তিনি বলেন, 'বুধবার গরুর দাম আরও পড়ে গেছে, সোমবার ও মঙ্গলবারের চেয়েও কম।'
ছাগল ব্যবসায়ীরাও একই ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছেন। শেরপুর থেকে ভাটারায় ১২৭টি ছাগল নিয়ে আসা ছোটন খান জানান, দুই দিনে তিনি মাত্র চারটি ছাগল বিক্রি করতে পেরেছেন। তিনি বলেন, 'এবার ছাগল বেশি দামে কিনেছি। কিন্তু গরুর দাম কম থাকায় ক্রেতারা ছাগলের জন্য বাড়তি দাম দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।'
এদিকে, আফতাবনগর ও মেরাদিয়ায় কোরবানির হাট না বসায় ক্রেতারা ভোগান্তিতে পড়েছেন।
আফতাবনগরের কামরুল হাসান ভাটারা হাট থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় একটি গরু কিনেছেন। তিনি বলেন, 'আগে আশপাশেই হাট বসত, সেখানে ডেলিভারির ব্যবস্থাও ছিল। এখন অনেক দূরে যেতে হচ্ছে, আবার পরিবহন খরচও বেশি পড়ছে।'
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবারে কোরবানির পশুর জোগান চাহিদার তুলনায় ২০ লাখ বেশি। চলতি বছর হাটে তোলা হচ্ছে মোট ১ কোটি ২৪ লাখ পশু—এর মধ্যে ৫৬ লাখ গরু ও মহিষ এবং ৬৮ লাখ ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য পশু। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ।
সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি নিয়ে চট্টগ্রাম ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মালিক মোহাম্মদ ওমর বলেন, 'বাজারে গরুর অতিরিক্ত সরবরাহ থাকায় দাম কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি, যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি সাধারণত বড় কোরবানির আয়োজন করেন, তাদের অনেকেই এবার দেশে নেই। ফলে চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।'
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবু সুফিয়ান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোরবানির পশুর জোগান প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। আমরা হাটগুলো সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখছি। পশুর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আমাদের মেডিকেল টিমও মাঠে কাজ করছে। পশুর কোনো ঘাটতি হবে না।'
গরুর চেয়ে মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার উৎপাদন বেশি
গত দুই দশকে বাংলাদেশে গবাদিপশু হিসেবে গরুর উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। অথচ একই সময়ে মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা বেড়েছে যথাক্রমে ৪৪ শতাংশ, ৪৭ শতাংশ ও ৬৪ শতাংশ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে চারণভূমি ক্রমাগত কমে আসায় গরুর পাল বৃদ্ধির চেয়ে এখন উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকেই জোর দিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে গরুর জাত উন্নয়নের কাজ চলছে। অন্যদিকে মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রেও জেনেটিক উন্নতির মাধ্যমে নতুন খামার গড়ে উঠছে। ফলে এদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উৎপাদন শাখার পরিচালক এ বি এম খালেদুজ্জামান বলেন, 'চারণভূমি কমে যাওয়ায় আমরা এখন জাত উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আগে গরু যেখানে দিনে ২ লিটার দুধ দিত, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪ থেকে ৪.৫ লিটার। ওজনও বেড়ে হয়েছে ১২ থেকে ১৫ মণ, যেখানে আগে ছিল ৩ থেকে ৩.৫ মণ।'
তিনি জানান, মহিষ এখন ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কারণ এর মাংসে ইনট্রামাসকুলার ফ্যাট কম থাকে, ফলে এটি স্বাস্থ্যকর। তিনি বলেন, 'মহিষ পালনে খরচ কম, দ্রুত বাড়ে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও ভালো। কৃত্রিম প্রজননের সাহায্যে এর উৎপাদনও বাড়ছে।'
মহিষের উৎপাদন বাড়লেও হাটে সংখ্যায় কম
মহিষের উৎপাদন ৪৪ শতাংশ বাড়লেও কোরবানির হাটে এর দেখা মিলছে খুব কম। লক্ষ্মীপুরে কোরবানির জন্য প্রস্তুত প্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার পশুর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারই মহিষ। তবু জেলার বড় বাজার—মোল্লারহাট ও রামগতি হাটে হাজারো পশুর ভিড়ে মহিষ দেখা যায় হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র।
ভোলার এক খামারি যিনি ১৮টি মহিষ নিয়ে এসেছেন, তিনি বলেন, 'মহিষ তুলনামূলকভাবে কম খায়, ওষুধ লাগে কম, দ্রুত বড় হয় এবং এখন গরুর মাংসের সমমূল্যে বিক্রি হওয়ায় লাভও বেশি।'
প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন আমাদের বগুড়া ও লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি