সরকারি হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা: চিকিৎসকরা অনিশ্চয়তায়, ভোগান্তিতে রোগীরা

স্বল্প খরচে চোখের ছানি অপারেশনের আশায় গত মাসে লালমনিরহাট থেকে ঢাকায় এসেছেন সুফিয়া বেগম। তবে দীর্ঘ এক মাস অপেক্ষা করেও রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে, শেষ পর্যন্ত বেসরকারি একটি হাসপাতালে ৮০ হাজার টাকা খরচ করে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন তিনি। অথচ সরকারি হাসপাতালে এই অপারেশনের খরচ পড়ত মাত্র ২০ হাজার টাকা।
গত বছরের অক্টোবরে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগার পর থেকেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চক্ষু অপারেশন থিয়েটার বন্ধ রয়েছে। আগুনে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও চালু হয়নি অপারেশন থিয়েটার। ফলে বাধ্য হয়েই বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা করিয়েছেন সুফিয়া বেগম।
সাত মাসেও কেন অপারেশন থিয়েটার চালু হয়নি জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শর্ট সার্কিটে কিছু যন্ত্রপাতি পুড়ে গেছে। অটি রুম পুনঃসংস্কার করেছি, অন্য রুম থেকে কিছু যন্ত্রপাতি এনেছি। তবে কিছু মেশিন এখনো রিপ্লেস করা হয়নি। কবে নাগাদ সব চালু হবে বলতে পারছি না। আমরা চেষ্টা করছি, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, কাগজপত্র পাঠিয়েছি।"
রাজনৈতিক অস্থিরতায় অচলাবস্থা
শুধু সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল নয়, পুরো স্বাস্থ্যখাতজুড়েই চলছে এমন অচলাবস্থা। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক সরকারি চিকিৎসক বদলি হয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক অভিযোগ করেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী চিকিৎসকেরা গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রেখেছেন এবং নতুন বদলি হওয়া চিকিৎসকদের দায়িত্ব গ্রহণে বাধা দিচ্ছেন।
ফলে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট চরমে পৌঁছেছে, আর এর দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রোগীরা। কেউ কেউ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিরক্ত হয়ে ইতোমধ্যে পদত্যাগও করেছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি স্বাচিবের কমিটিতে ছিলাম, তবে বড় কোনো নেতা নই। ৫ আগস্টের পর অফিস করি, রোগীও দেখি, তবে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। এখন আমার অধীনে আর কোনো পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী রাখা হচ্ছে না। বরং যারা ছিল, তাদের ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।"
তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আগে সপ্তাহে একটি করে কিডনি প্রতিস্থাপন হতো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে মাত্র দুটি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে। কারণ, যিনি এই অপারেশন করতেন তিনি রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে এখন হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারছেন না। নতুন টিম গঠনের উদ্যোগও না থাকায় কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে।
এদিকে, বিএমইউ-এর কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষ ট্রান্সপ্লান্ট টিম গঠন করা সময়সাপেক্ষ। তাই রাজনৈতিক পরিচয় উপেক্ষা করে আগের অভিজ্ঞ টিমকে ফের কাজের সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে করে সাধারণ রোগীরা উপকৃত হন।
বদলির ৭ মাসেও যোগ দিতে পারছেন না অনেকে
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক (প্লাস্টিক সার্জারি) ডা. হোসাইন ইমামকে গত ২ সেপ্টেম্বর রংপুর মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বদলি করা হয়। কিন্তু বদলির পর রংপুর মেডিকেলের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা তাকে 'স্বৈরাচারের দালাল' আখ্যা দিয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে সংবাদ সম্মেলন করেন।
পরে ১ জানুয়ারি তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) পদে পদায়ন করা হয়। কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি সেখানে যোগ দিতে পারেননি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২০ মার্চ পর্যন্ত ৬,৫৫৬ জন চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছে। এরমধ্যে অনেক আওয়ামীপন্থী চিকিৎসক নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারেননি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০০ জনের মতো চিকিৎসক এখনো যোগ দিতে পারেননি। তিনটি মেডিকেলেও কেউ কেউ জয়েন করতে পারেননি। স্টুডেন্টরা একসেপ্ট করছেন না। কাউকে দোষ দিচ্ছি না। একটু সময় নিচ্ছি। ধীরে ধীরে সমাধান হচ্ছে।"
"আমরা খোঁজ নিচ্ছি কোন কোন কলেজে সেনসিটিভিটি কম, সেখানে তাদেরকে দিচ্ছি," যোগ করেন তিনি।
পারিবারিক সংকটেও পড়তে হচ্ছে চিকিৎসকদের
প্লাস্টিক সার্জন দীপ্তিকে (ছদ্মনাম) দিনাজপুরে বদলি করা হলেও তার স্বামী ঢাকায়। ৮ বছরের সন্তান রয়েছে তার, মা প্রতি সপ্তাহে দেখা করতে যান।
"আমাকে কোনো বিভাগে অ্যাসাইন করা হয়নি। পুরুষ ডরমিটরিতে একা থাকি। মানসিকভাবে খুব কষ্ট হচ্ছে," বলেন তিনি।
আরেক চিকিৎসক দম্পতির দুই শিশু সন্তান রয়েছে। একজন বদলি হয়েছেন খুলনায়, আরেকজন ময়মনসিংহে। তারা বলেন, "আমরা এখন ক্যারিয়ার আর সন্তানের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছি।"
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এক রেসিডেন্ট সার্জনকে রাজবাড়ীতে বদলি করে গ্রেড ৭ থেকে ৯-এ নামিয়ে আনা হয়। প্রতিবাদ করলে আদেশ বাতিল হয়, কিন্তু কিছুদিন পর ফের ফরিদপুরে বদলি করা হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৫ বছরের চাকরি ছেড়ে পদত্যাগ করেছেন।
ক্যান্সার চিকিৎসায় নেই তেমন অগ্রগতি
ক্যান্সার, কিডনি, হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার জন্য বহু রোগী বিদেশমুখী হন। অন্তর্বর্তী সরকার এসব চিকিৎসা উন্নত করার ঘোষণা দিলেও এখনো অগ্রগতি নেই।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে থাকা ৮টি রেডিওথেরাপি মেশিনের ৭টিই বিকল। মাত্র একটি মেশিন দিয়ে দিনে ১০০ থেকে ১৫০ জনকে থেরাপি দেওয়া হচ্ছে, যদিও দৈনিক ৩০০-৩৫০ রোগী আসেন। অধিকাংশ রোগী সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
সরকারি হাসপাতালে পেট সিটি স্ক্যান করতে সিরিয়ালের জন্য রোগীদের ৩-৪ মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
অপারেশনাল ও এক্সিট প্ল্যান কার্যকর নয়
দেশের স্বাস্থ্য খাতের অধিকাংশ কার্যক্রম চলে পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত কর্মসূচির (ওপি) আওতায়। শেষ 'চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি' (এইচপিএনএসপি) শেষ হয়েছে গত বছরের জুনে।
বর্তমান সরকার চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত দুই বছরের একটি এক্সিট প্ল্যান তৈরির কথা বললেও এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
ওপি না থাকায় ৪২৯টি এনসিডি কর্নারে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও অ্যাজমার ওষুধ সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ সাপোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ৯ মাসেও অফিসের বসার জায়গা পাননি।
বাজেট বাস্তবায়নে সর্বনিম্ন রেকর্ড
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত স্বাস্থ্যখাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন মাত্র ১৬ শতাংশ।
এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ১৪.৪১ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ মাত্র ২.২৯ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে।
পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ডা. মুহাম্মদ আবদুস সাবুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা ছাড়া স্বাস্থ্যখাতে আর কিছুই চোখে পড়ছে না। এখনো যদি ওপি রেডি না হয় তাহলে সেটা প্ল্যানিং কমিশনে কবে জমা হবে?"
"আগামী এডিপির খসড়া তৈরি হচ্ছে। ৮টা বা ১০টা—যে কয়টা প্রকল্প করুক, তা তো তৈরি করতে হবে। নাহলে তো ২০২৬ সালের বাজেট প্রক্রিয়াও ধাক্কা খাবে। হাসপাতালে ওষুধ না থাকলে তো গরিব মানুষের কষ্ট বাড়বে। স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের মতো অসংক্রামক রোগ বাড়বে," সতর্ক করেন তিনি।