এনবিআরের অচলাবস্থা নিরসনে উপায় খুঁজছে সরকার

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তি ও সংস্কার কমিটির সুপারিশ উপেক্ষার প্রতিবাদে দেশব্যাপী কর্মকর্তাদের কলম বিরতি কর্মসূচিতে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনে উপায় খুঁজছে সরকার।
এর অংশ হিসেবে এনবিআর চেয়ারম্যানসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। শিগগিরই সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে বৈঠক হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
আন্দোলনকারী কর্মকর্তারাও আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শনিবার সকালে চেয়ারম্যান এনবিআরের মেম্বারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অধিকাংশ সদস্যই ইতিবাচকভাবে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানান।"
আন্দোলনকারীদের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, "আমরা আভাস পেয়েছি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের। দুই-এক দিনের মধ্যেই তা হতে পারে বলে আশা করছি।"
সরকারের এক সচিব বলেন, "আমরা সমাধান চাই, কিন্তু আন্দোলনকারীরা এখনো অনড়।"
এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে বলেছে, অর্ডিন্যান্সটি দ্রুত জারি হওয়ায় রাজস্ব ব্যবস্থা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সংস্থাটি অর্ডিন্যান্স স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্কার কমিটি সুপারিশ প্রকাশ না করে এবং একতরফাভাবে অধ্যাদেশ জারির ফলে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
এনবিআর সংস্কার কমিটির সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, "যে সুপারিশ ছিল, সেটিই সংকটের সমাধানের পথ। অন্য কোনো পথ দেখি না।"
সূত্র জানায়, সুপারিশে এনবিআর বিলুপ্ত করে 'রেভিনিউ পলিসি ডিভিশন' ও 'রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন' গঠনের কথা বলা হয়েছিল। দুই বিভাগের প্রধান সচিব পদমর্যাদার হবেন এবং তারা ট্যাক্স ও কাস্টমস ক্যাডার থেকে নিয়োগ পাবেন—এমন প্রস্তাব ছিল নীতিমালায়।
কিন্তু অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, পলিসির প্রধান হতে পারেন 'যেকোনো যোগ্য সরকারি কর্মকর্তা' এবং ম্যানেজমেন্ট প্রধান হবেন 'রাজস্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন' ব্যক্তি। এই অস্পষ্টতার সুযোগে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়নের আশঙ্কা করছেন আন্দোলনকারীরা।
এছাড়া, গভীর রাতে অধ্যাদেশ জারি ও সুপারিশ প্রকাশ না করায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে সন্দেহ আরও বেড়েছে।
এনবিআর রিফর্ম ইউনিটি পরিষদ-এর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'অধ্যাদেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিরূপ সংশোধনের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে প্রভাবশালী মহলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।'
ফরিদ উদ্দিন বলেন, "নেতৃত্ব নিয়োগ হলো সংস্কারের মাত্র ৫ শতাংশ কাজ, কিন্তু তা ভুল হলে বাকি ৯৫ শতাংশ কাজই ভেস্তে যাবে।"
কমিটির আরেক সদস্য মো. আমিনুর রহমান বলেন, "সমাধানের একাধিক উপায় থাকতে পারে, এক জায়গায় অনড় থাকা উচিত নয়।"
সাবেক এনবিআর সদস্য সৈয়দ মো. আমিনুল করিম বলেন, "রাজস্ব বিভাগের প্রধান অবশ্যই এনবিআরের কর্মকর্তা হওয়া উচিত। রাজস্ব ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া পলিসি তৈরি সম্ভব নয়।"
তিনি বলেন, "গত পাঁচ দশকে এনবিআর কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারেনি— কারণ প্রধান ছিলেন বাইরের (মূলত প্রশাসন ক্যাডার থেকে)। এবারও পলিসির কাজ করাবেন এনবিআরের কর্মকর্তাদের দিয়ে, কিন্তু মর্যাদা থাকবে সহকারীর মতো।"
তিনি আরও বলেন, "পলিসির অধীনে আপিল ট্রাইব্যুনালসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করাও যৌক্তিক নয়।"
সমাধানের সম্ভাব্য পথ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, "আলোচনায় এমন প্রস্তাব উঠেছে যে, পলিসি ডিভিশনের প্রধান পদটি প্রশাসন ক্যাডারসহ অন্যদের জন্য রাখা যেতে পারে, আর ম্যানেজমেন্টের প্রধান হবেন এনবিআরের কর্মকর্তা।"
তিনি বলেন, "প্রশাসন ক্যাডার আশঙ্কা করছে, এনবিআরের আন্দোলনে সাফল্য এলে অন্য বিভাগেও একই ধরনের দাবি উঠবে।"
তিনি আরও বলেন, "এনবিআর প্রধান এনবিআর থেকে হলে এটি যে একেবারেই নতুন হবে, তা নয়। কেননা সরকারের ফরেন ক্যাডার ও লেজিসলেটিভ বিভাগের প্রধান স্ব স্ব ক্যাডার থেকেই নিয়োগপ্রাপ্ত হন।"
"ফলে আলোচনা হলেও আমরা এর যৌক্তিক সমাধান চাইবো," যোগ করেন তিনি।
প্রধান উপদষ্টার নির্দেশনা চান আন্দোলনকারীরা, দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি
শনিবারও দেশের সব কাস্টমস হাউজ, ভ্যাট ও ট্যাক্স অফিসে পাঁচ ঘণ্টার কলম বিরতি পালন করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আজ রোববার তা বাড়িয়ে ছয় ঘণ্টা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার নিপুণ চাকমা বলেন, "মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য অপেক্ষা করছি।"
যুগ্ম কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, "আমরা সংস্কার চাই, তবে তা বাস্তবসম্মত, অংশীজনদের মতামত নিয়ে ও এনবিআর কর্মকর্তাদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা স্বীকৃত হওয়া উচিত।"
এনবিআরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, "দাবি না মানলে আমাদের আরও কঠোর কর্মসূচিতে যেতে হবে।"
বর্তমানে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, আমদানি-রপ্তানি ও বাজেট প্রস্তুতির কাজ এই কর্মসূচির বাইরে রয়েছে।
এদিকে, কর্মকর্তাদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগে বিসিএস কাস্টমস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সহ অধিকাংশ সদস্য পদত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে শনিবার এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিসিএস ট্যাক্সেশন অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়েছে।