‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ ঘোষণাপত্র: সম অধিকার দাবি

নারী-পুরুষ সমানাধিকারের দাবিতে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আজ (১৬ মে) 'নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা'-শীর্ষক কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
৫টার দিকে অংশগ্রহণকারীরা বর্ণিল ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে বিকেল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে খামারবাড়ি সড়ক হয়ে ফার্মগেট, তারপর ইন্দিরা রোড হয়ে আবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ফিরে এসে যাত্রা শেষ করেন।

এসময় নারীর সমান অধিকারের দাবিতে অংশগ্রহণকারীরা নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন। এসব স্লোগানে উঠে এসেছে—নারীর অধিকার, মর্যাদা, নিরাপত্তা, শ্রমিকের অধিকার, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা এবং ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সংহতির মতো বিষয়গুলো।
এর আগে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে এ কর্মসূচি শুরু হয়।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানির ঘটনার প্রতিবাদে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
'সমতার দাবিতে আমরা' স্লোগানের এই কর্মসূচিতে প্রগতিশীল নারী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিককর্মী, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়েছেন।

দুপুর থেকেই বিভিন্ন ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে তাদের এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আসতে দেখা যায়।
এ কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, হিল উইমেনস ফেডারেশন, সিপিবি নারী সেল, নারী মুক্তি কেন্দ্রসহ ৫০টি সংগঠন।

আয়োজকরা জানিয়েছেন, মূলত নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এই কর্মসূচি হচ্ছে। পাশাপাশি নারীদের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে কর্মসূচি হচ্ছে।
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পরপরই আয়োজকেরা একটি ঘোষণা পাঠ করেন। যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল—ঐক্যবদ্ধ নারীবাদী ও সামাজিক ন্যায়বিচার আন্দোলন গড়ে তোলা।

তাদের ঘোষণাপত্রে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার যৌথ দাবির কথা বলা হয়, যেখানে সকল মানুষ—বিশেষ করে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী—সম্মান, স্বাধীনতা ও অধিকার লাভের নিশ্চয়তা পাবে।
এই চলমান নারী নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে বাংলাদেশের ন্যায়বিচারের জন্য দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়—যার মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, আদিবাসী অধিকার আন্দোলন এবং শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াই।

ঘোষণাপত্রে অভ্যুত্থানের পরও চলমান পিতৃতান্ত্রিক সহিংসতা ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে নারীদের উপর নির্বিচারে চলতে থাকা নানা হুমকির কথা তুলে ধরা হয়েছে—যেমন: অনলাইন হয়রানি, আন্দোলনে বাধা, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, পরিকল্পিত মব-আক্রমণ, মোরাল পুলিশিং এবং নানান ধরনের হুমকি প্রদান প্রভৃতি।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও সরকার নিজস্ব সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে; বরং কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে দিয়েছে এবং সমন্বিত নারীবিদ্বেষী আক্রমণের মুখে নীরব থেকেছে।

ঘোষণাপত্রে বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান কাঠামোগত বৈষম্যেরও কঠোর নিন্দা জানানো হয়েছে। যেমন- মজুরি বৈষম্য, জমির মালিকানায় নারীদের বঞ্চনা, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, আইনি অযোগ্যতা এবং বহুবিধ লিঙ্গপরিচয়সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতি অবহেলা।
ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নারী, সংখ্যালঘু এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার কোনোভাবেই আপসযোগ্য নয়।

এতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল এই দাবিগুলোকে উপেক্ষা বা দমন করতে পারে না—তা হলে তা হবে জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
এতে আরও আহ্বান জানানো হয়েছে—অনানুষ্ঠানিক শ্রমের স্বীকৃতি, যৌনকর্মী ও এলজিবিটিকিউ+ জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ঘোষণাপত্রে উত্থাপিত কিছু নির্দিষ্ট দাবি হলো-
• নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও অপপ্রচারের বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ।
• রাজনৈতিক অংশগ্রহণে সমতা (নির্বাচনে কমপক্ষে ৩৩% নারী প্রার্থী নিশ্চিত করা)।
• জমির অধিকার, বৈবাহিক সমতা এবং প্রজনন অধিকার সুরক্ষায় আইনি সংস্কার।
• প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসনে জরুরি বিনিয়োগ।
• যৌনকর্মী, লিঙ্গ বৈচিত্র্যসম্পন্ন ব্যক্তি ও অভিবাসী শ্রমিকদের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
ভয় ও নীরবতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়ে ঘোষণাপত্রটি এক দৃঢ় আহ্বানের মাধ্যমে শেষ হয়।
ঘোষণাপত্রের লেখকরা বলেন, ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে না ওঠা পর্যন্ত তারা তাদের লড়াই চালিয়ে যাবেন। তারা অঙ্গীকার করেন, নারীর অধিকার প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থান নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহির আওতায় আনবেন।

তাদের চূড়ান্ত অঙ্গীকার হলো—তাদের কণ্ঠ রোধ করা যাবে না, তারা পিছু হটবেন না এবং ন্যায় ও সমতার এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।







