৪৩ মাসের মধ্যে এপ্রিলে সর্বনিম্ন বিদেশি কর্মসংস্থান, সৌদিতে নিয়োগ কমেছে ৬৪%

২০২৫ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৪৯,৯৮৩ জন কর্মী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যা গত ৪৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ওই মাসে সৌদি আরবে কর্মী নিয়োগ আগের মাসের তুলনায় ৬৪ শতাংশের বেশি কমেছে—যা এই পতনের মূল কারণ।
জানুয়ারির শেষ দিক থেকে সৌদি গমনেচ্ছু একক ভিসাধারীদের জন্য রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুমোদন (অ্যাটেস্টেশন) বাধ্যতামূলক করায় নিয়োগে এই ধস নেমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) জানিয়েছে, অনেক বাংলাদেশি কর্মীর কর্মপরিচয়পত্র বা চাকরির নিশ্চয়তা ছাড়াই সৌদি আরবে যাওয়ার অভিযোগ ওঠায় ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ইস্যুতে কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিলে বিদেশি কর্মসংস্থান মার্চ মাসের তুলনায় ৫২ শতাংশ এবং গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪১ শতাংশ কমেছে।
এদিকে, দুর্নীতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনে মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ওমান ও বাহরাইনের মতো বড় শ্রমবাজারগুলো এখনো তাদের বাজার বন্ধ রেখেছে।
এ পরিস্থিতিতে সৌদির বাজারও সংকুচিত হওয়ায় সামগ্রিক শ্রমবাজার খাতে বড় ধরনের ধস নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার দীর্ঘদিন ধরেই সৌদি আরবনির্ভর। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে দেশের মোট বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রায় ৫৭ শতাংশই হয়েছিল সৌদি আরবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এপ্রিলে বিদেশগামী কর্মীর সংখ্যা হঠাৎ কমে যাওয়া মূলত এই নির্ভরতারই খেসারত।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ২৮,৬৭১ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে সৌদি আরব—যেখানে মার্চে এই সংখ্যা ছিল ৮০,৬৬৩ জন। এপ্রিলে কর্মী নিয়োগে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কাতার; আলোচ্য সময়ে ৬,২৯৫ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে দেশটি। এছাড়া সিঙ্গাপুর, কুয়েত, জর্ডান ও কিরগিজস্তানেও কিছু কর্মী গিয়েছেন।
সৌদি আরবে কর্মী প্রেরণে জটিলতা নিরসনে নিয়োগদাতারা সহজ শর্তে ডিমান্ড লেটার ইস্যুর দাবি জানিয়েছেন। এর আগে নিয়োগ সংস্থাগুলোর প্রতিবাদের মুখে মার্চ মাসে বেশ কিছু আটকে থাকা ভিসা ছাড় করা হয়।
এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) একটি অংশ আজ প্রবাসী কল্যাণ ভবনের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে।
তাদের দাবি, সৌদি আরবগামী কর্মীদের বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স কার্ড ইস্যুতে জটিলতা দূর করতে হবে এবং মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিন্ডিকেট অপসারণ করতে হবে।
তারা এই দাবিগুলোর বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি স্মারকলিপিও পেশ করবেন।
বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ফেব্রুয়ারিতে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার পর আমরা আন্দোলনে নামি এবং বিএমইটির মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এরপর স্থগিত থাকা ডিমান্ড লেটার ছাড় করা হয় এবং ক্লিয়ারেন্স কার্ড ইস্যু শুরু হয়। কিন্তু এপ্রিল মাসে সেই প্রক্রিয়া আবারও থেমে গেছে, অনেক কর্মী বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স কার্ড পাননি।"
বন্ধ শ্রমবাজারগুলো যেন পুনরায় চালু করা হয়, সেজন্য তিনি সরকারকে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি, দক্ষ কর্মীর চাহিদা বেশি—ইউরোপের দিকে এমন নতুন গন্তব্য খোঁজার তাগিদও দেন।
সৌদি আরবগামী বাংলাদেশি কর্মীদের ভিসা মূলত দুই ধরনের—সিঙ্গেল ভিসা এবং গ্রুপ ভিসা। একই প্রতিষ্ঠানে ২৫ জনের বেশি কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে গ্রুপ ভিসায় অনেক আগে থেকেই দূতাবাসের অ্যাটেস্টেশন বাধ্যতামূলক।
সিঙ্গেল বা একক ভিসার ক্ষেত্রে আগে কিছুটা শিথিলতা থাকলেও, সম্প্রতি চাকরির নিশ্চয়তা বা বৈধ আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) ছাড়া কর্মীদের সৌদি আরব যাওয়ার অভিযোগ ওঠার পর আবারও এই অ্যাটেস্টেশন প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এ প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য হলো, চাকরির অফার যাচাই ও কর্মীরা যেন বিদেশে গিয়ে প্রতারিত না হন—তা নিশ্চিত করা।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বিএমইটি জানিয়েছে, সিঙ্গেল ভিসার ক্ষেত্রে দূতাবাসের অ্যাটেস্টেশন বা সত্যায়ন বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তটি বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন, ২০১৩ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিধিমালা, ২০১৭-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর লক্ষ্য হলো নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা।
শুরুতে, সৌদি আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার হওয়ায় সেখানে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করতে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভিসা ও ডিমান্ড লেটার অনুমোদন দিত। তবে দুর্বল কর্মপরিবেশ এবং অনেক কর্মীর আগেভাগেই দেশে ফেরার ঘটনা বাড়তে থাকায় দূতাবাস কঠোর হতে বাধ্য হয়।
অ্যাটেস্টেশন প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা আনতে রিয়াদস্থ দূতাবাস অনলাইনে ডিমান্ড লেটার সত্যায়নের একটি ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা ইস্যুতে অগ্রগতি
এদিকে, টানা কূটনৈতিক তৎপরতার পর বাংলাদেশিদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর ভিসা চালুর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
গতকাল ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউএই রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আলী আলহামুদি।
এই আলোচনার মাধ্যমেই দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা আরব আমিরাতের শ্রমবাজার পুনরায় চালু হওয়ার পথ সুগম হয়েছে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৈঠকে ইউএই রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আলী আলহামুদি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের সঙ্গে লুৎফে সিদ্দিকীর সক্রিয় যোগাযোগের প্রশংসা করেন। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভিসা সহজীকরণ ও বিনিয়োগ সহযোগিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অর্ধডজনের বেশি মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাষ্ট্রদূত আলহামুদি বিশেষ দূতকে জানান, বর্তমানে ঢাকায় ইউএই দূতাবাস প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০টি ভিজিট ভিসা ইস্যু করছে। এছাড়া ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলের জন্য একসঙ্গে বড় পরিসরে ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা হচ্ছে, যা দুই দেশের মধ্যে পিপল-টু-পিপল কানেকশন এবং বাণিজ্যিক পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
আরও একটি বড় অগ্রগতি হলো—সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় দক্ষ কর্মীদের জন্য অনলাইনে স্কিল্ড এমপ্লয়মেন্ট বা কর্মসংস্থান ভিসা ইস্যুর ব্যবস্থা পুনরায় চালু করেছে। এর মাধ্যমে সম্প্রতি বিপণন ব্যবস্থাপক এবং হোটেল কর্মীদের ভিসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, নিরাপত্তা প্রহরীদের (সিকিউরিটি গার্ড) জন্যও ৫০০টি ভিসা ইতোমধ্যে ইস্যু করা হয়েছে এবং আরও ১,০০০টি ভিসা অনুমোদিত হয়েছে, যা শিগগির ইস্যু করা হবে।
আশা করা হচ্ছে, আগামী মাসগুলোতে সংযুক্ত আরব আমিরাত ধীরে ধীরে ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধগুলো আরও শিথিল করবে।