২৩ মে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ঘোষণা হেফাজত ইসলামের

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ ৪ দফা দাবিতে ২৩ মে বাদ জুমা দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এছাড়া, নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আগামী তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় সম্মেলন করবে সংগঠনটি।
আজ (৩ মে) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এক মহাসমাবেশে সংগঠনের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
সমাবেশে ১২ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাহফুজুল হক।
হেফাজতের নেতারা বলেন, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান হওয়ায় কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো নীতি তারা মেনে নেবে না। তারা অভিযোগ করেন, নারী কমিশনের সংস্কার প্রতিবেদনে ইসলামী অনুশাসন পরিপন্থী সুপারিশ রাখা হয়েছে, যা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
নেতারা ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে 'গণহত্যা'র বিচার দাবি করেন। তারা বলেন, বিডিআর বিদ্রোহ ও জুলাই আন্দোলনের ঘটনার তদন্তে কমিশন গঠন হলেও শাপলা চত্বরে সংঘটিত ঘটনার তদন্তে আজও কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি।
সমাবেশে আরও অভিযোগ করা হয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো তুলে নেওয়া হলেও, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে 'ফ্যাসিবাদী' শেখ হাসিনা সরকারের আমলে করা মামলা আজও বহাল রয়েছে। এসব মামলা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
নেতারা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজনে জীবন দেওয়া হবে, কিন্তু কোআন-সুন্নাহবিরোধী কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না।
পাশাপাশি, ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলিম নিধন ও নিপীড়ন বন্ধে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়।
আজ সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলে হেফাজতের এ মহাসমাবেশ। এতে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার হেফাজত কর্মী ও সমর্থক ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হন।
হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে শীর্ষ ওলামা-মাশায়েখ ও ইসলামী চিন্তাবিদরা মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

এর আগে ভোর থেকেই শাহবাগ, দোয়েল চত্বর ও নীলক্ষেতে থেকে মিছিল নিয়ে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং রংপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে নেতা-কর্মীরা মহাসমাবেশে যোগ দেন।
মহাসমাবেশে হেফাজতের নায়েবে আমির হযরত মাওলানা আব্দুল আউয়াল বলেন, 'আমরা স্পষ্টভাবে দাবি জানাতে চাই—নারী সংস্কার নামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, তা সংশ্লিষ্টদেরসহ ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা হোক। আগামী দিনে ইসলামের বিরুদ্ধে যত ধরনের আইন করা হবে, সেগুলোর প্রতিবাদে আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।'

নায়েবে আমির হযরত মাওলানা আনাস বলেন, 'যারা এই নারী সংস্কার প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা সমাজে ব্যভিচারীদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে চাইছে। তারা সম্পদের ক্ষেত্রে সমানাধিকার দাবি করছে। অথচ আল্লাহ যেসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য রেখেছেন, সেখানে সমানাধিকার চাপিয়ে দেওয়া ইসলামবিরোধী।'
নায়েবে আমির মুফতি জসিম উদ্দিন বলেন, '৯৫ শতাংশ মুসলমানের দেশে বহুত্ববাদ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই দেশ হবে তাওহিদ বা একত্ববাদের ভিত্তিতে পরিচালিত। ইসলামে নারীদের যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে তা দেওয়া হয়নি। বরং অন্য ধর্মে নারীদের জীবন্ত কবর দেওয়া হত।'
তিনি বলেন, 'আমরা আপনাদের সরকারে বসিয়েছি এই আশায় যে, আপনারা প্রথম সংস্কার করবেন তাদের নিয়ে—যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন।'

সংগঠনটির নায়েবে আমির হযরত মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরি বলেন, 'হেফাজতের যেসব দাবি রয়েছে, সেগুলো সারাদেশের সাধারণ মানুষের দাবি। মহিলা কমিশন অবশ্যই বাতিল করতে হবে। যারা জেলে বন্দি আছেন, তাদের মুক্তি দিতে হবে। ভারত ও ফিলিস্তিনে মুসলমানদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তা বন্ধ করতে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে।'
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব এবং হেফাজতের সহ-সভাপতি আহমদ আবদুল কাদের বলেন, 'নারী কমিশনের প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড ও জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত হত্যার বিচার করতে হবে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিচারও করতে হবে। এই দাবিগুলো মানা না হলে আমরা পুরো জাতিকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে নেমে আসব।'

হেফাজত নেতা আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক কাসেমী বলেন, 'নারী কমিশনে কেন অসভ্য নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? এ ধরনের নারীদের দিয়ে সভ্য নারীদের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করা কেউ মেনে নেবে না।'
তিনি বলেন, 'আমরা দেশবিরোধী যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেব। আমরা কোনো বিদেশি ষড়যন্ত্র এ দেশে কার্যকর হতে দেব না। আমরা এ দেশে ভারত কিংবা খ্রিস্টানদের কোনো ষড়যন্ত্র দেখতে চাই না।'

এদিকে, হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, 'নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের বিরোধিতা করতে গিয়ে যেন আমরা মূল দাবি থেকে ফিরে না আসি। আমাদেরকে গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান জারি রাখতে হবে। এ দেশের আলেম সমাজ এক থাকলে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।'
মহাসমাবেশে উপস্থিত হয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, 'যেই শেখ হাসিনা ৫ মে এ দেশের আলেম ওলামার ওপর হামলা করেছে সেই হাসিনা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'ড. ইউনুস ভুলে যাবেন না। আপনাকে আমরা ক্ষমতায় বসিয়েছি। আওয়ামী লীগ এই বাংলাদেশে আসবে না। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় সংস্কার। আওয়ামী লীগ সারাদেশে কসাইতন্ত্র কায়েম করেছে। আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল না, একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। আমরা হাসিনার ফাঁসি নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো।'
হাসনাত বলেন, 'সংস্কারের নামে নারীদের নিয়ে যে বিতর্কিত প্রস্তাবনা এসেছে সেগুলো পরিবর্তন করতে হবে। আমি বলবো আজকে সমাবেশের মাধ্যমে ৫ মে শহীদের তালিকা আপনারা প্রকাশ করুন এবং তার বিচারের দাবি জারি রাখুন।'

হেফাজতের চার দফা দাবি: নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবেদন বাতিল করা, সংবিধানে বহুত্বদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল করতে হবে, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরের কথিত হত্যাকাণ্ডসহ সব গণহত্যার বিচার করতে হবে এবং ফিলিস্তিন ও ভারতে 'মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে' সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে।