রোগীদের বিদেশমুখীতা কমাতে বিশ্বমানের হাসপাতাল নির্মাণের সুপারিশ করবে সংস্কার কমিশন

চিকিৎসার জন্য রোগীদের বিদেশমুখীতা কমাতে দেশে বিশ্বমানের সেন্টার অব এক্সিলেন্স হাসপাতাল নির্মাণ, মেডিকেল কলেজগুলোর মানোন্নয়ন এবং যেসব রোগের চিকিৎসায় রোগীরা বিদেশমুখী হন—সেসব চিকিৎসাসেবা দেশেই গড়ে তুললে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ট্যাক্স হলিডেসহ নানা সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্যখাত-বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
কমিশনের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, তারা সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত করা, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ, ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, ই-প্রেসক্রিপশন চালু, মেডিকেল শিক্ষার মানোন্নয়ন, চিকিৎসা যন্ত্রপাতির স্থানীয় উদ্ভাবনে সহায়ক আইন এবং রোগী-চিকিৎসক সুরক্ষা আইন প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সুপারিশ করতে যাচ্ছেন।
কমিশনের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসা, কিডনি, লিভার ও হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট এবং বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সেবার জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি প্রতিবছর বিদেশে যান।
তিনি বলেন, "এই রোগগুলোর চিকিৎসাসেবা যেন দেশেই নিশ্চিত করা যায়, সেজন্য মেডিকেল কলেজগুলোর ভেতরেই এসব চিকিৎসা সুবিধা গড়ে তোলার সুপারিশ করব আমরা।"
তিনি আরও জানান, চিকিৎসাসেবায় অসন্তুষ্ট হলে রোগীরা যেন অভিযোগ জানাতে পারেন, সে জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মও চালু করার প্রস্তাব থাকবে।
বেসরকারি খাতে উৎসাহ দিতে যেসব হাসপাতাল সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি বা উন্নত ক্যান্সার চিকিৎসায় বিনিয়োগ করবে—তাদের জন্য ট্যাক্স হলিডে, ভ্যাট মওকুফসহ অন্যান্য প্রণোদনার প্রস্তাব দেবে কমিশন।
এই উদ্যোগে দেশের চিকিৎসাসেবার সক্ষমতা বাড়বে এবং এতে বিদেশমুখীতা কমবে বলে মন্তব্য করেন ওই সদস্য।
কমিশনের সদস্য ডা. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, "আমরা চাই, দেশের বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকায় বিশ্বমানের হাসপাতাল গড়ে উঠুক, যাতে বিদেশি রোগীরাও চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে আসেন।"
গত বছরের নভেম্বরে অধ্যাপক এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে এই কমিশন তাদের প্রস্তাবনা ও সুপারিশ জমা দেবে।
অধ্যাপক আজাদ খান টিবিএসকে বলেন, স্বাস্থ্যখাতকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে তাদের সুপারিশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে কমিশন গঠনের প্রস্তাব
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে মূল্য নির্ধারণে সমন্বয় ও তদারকির জন্য একটি স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের সুপারিশ করতে যাচ্ছে সংস্কার কমিশন।
বর্তমানে ১১৭টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। এটি বাড়িয়ে ৩০০ করা এবং সেই তালিকা প্রতি দুই বছর অন্তর হালনাগাদ করার প্রস্তাব থাকবে সংস্কার কমিশনের সুপারিশে।
নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের ওষুধও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এসব ওষুধ কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত সরবরাহ এবং কিছু বিনামূল্যে দেওয়ার সুপারিশও করা হবে।
কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন জানান, "ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনে স্থানীয় উদ্ভাবকদের জন্য আলাদা আইন এবং দ্রুত বাণিজ্যিকীকরণে সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা সুপারিশ করা হবে।"
চিকিৎসা সেবার মান নিশ্চিতে গাইডলাইন ও নজরদারি
চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়নে 'বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সেন্টার অব এক্সিলেন্স' গঠনের প্রস্তাব থাকবে সুপারিশে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি হবে, যা সব চিকিৎসককে অনুসরণ করতে হবে।
এছাড়া একটি কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইমপ্রুভমেন্ট ইউনিট থাকবে; চিকিৎসকরা নির্দেশনা অনুসরণ করছেন কি না, তা পর্যবেক্ষণ করবে এই ইউনিট এবং প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারবে।
সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে অটোনোমাস করার প্রস্তাবে বাজেট ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্বাধীনতা দেওয়া হবে। তবে বাংলাদেশ হেলথ কমিশনের আওতায় থাকবে তাদের কার্যক্রম।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল পরিচালনাসংশ্লিষ্ট আইনসমূহ আধুনিকায়নের সুপারিশও করা হবে, যা স্বাস্থ্য কমিশনের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হবে।
প্রথমে বড় বড় হাসপাতালগুলোতে ই-প্রেসক্রিপশন চালুর পর ধাপে ধাপে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এটি চালু করার প্রস্তাব থাকবে।
এছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (নিপোর্ট)-কে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের সুপারিশ করা হবে।
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের প্রস্তাব
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মান বিবেচনায় যৌক্তিক ও আধুনিক করার প্রস্তাব দেওয়া হবে। ইংরেজি মাধ্যমের পাঠ্যসূচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রশ্নপত্র তৈরি করার সুপারিশও থাকবে।
দেশকে ১১টি রিজিয়ন বা অঞ্চলে ভাগ করে রিজিওনাল, জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো তৈরি করা হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৃথক দুটি রিজিওনাল ইউনিট এবং আট বিভাগ ও পার্বত্য অঞ্চলের জন্য পৃথক ইউনিট থাকবে।
এছাড়া, রোগী ও চিকিৎসকদের সুরক্ষায় 'স্বাস্থ্যসেবাগ্রহীতা ও প্রদানকারী নিরাপত্তা আইন' প্রণয়নের সুপারিশ করবে কমিশন।