সবার জন্য বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের সুপারিশ করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন

সবার জন্য বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ, রেফারাল ব্যবস্থা চালু এবং অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন।
কমিশনের সদস্যরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানিয়েছেন, প্রস্তাবনায় বলা হবে, দেশের যেকোনো হাসপাতালে অস্বচ্ছল ২০ শতাংশ রোগী যেন বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পান এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র রোগীদের জন্য ১০ শতাংশ শয্যা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে কিনা, তা কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট বেতন-ভাতা চালু এবং প্রশিক্ষণকালীন অনারারি চিকিৎসকদের উপযুক্ত ভাতা প্রদানের সুপারিশও করবে কমিশন।
সুপারিশে আরও থাকছে প্রতিটি রোগীর জন্য ইউনিক আইডি চালু ও ই-প্রেসক্রিপশন ব্যবস্থার প্রস্তাব।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খানের নেতৃত্বে ১২–সদস্যের এই স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন গঠিত হয় গত বছরের ১৭ নভেম্বর। চলতি বছরের ২৭ মার্চ কমিশনের সময়সীমা বাড়িয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।
ডা. আজাদ খান এর আগে টিবিএস-কে জানান, ঈদের পর কমিশন তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
কমিশনের সদস্য ডা. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, "আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা সেবায় বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের সুপারিশ করবো। হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ মজুত থাকতে হবে এবং ভর্তিকৃত রোগীর চিকিৎসাও বিনামূল্যে দিতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "গ্রামীণ এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো থাকলেও নগরাঞ্চলে তা যথেষ্ট নয়। এ কারণে নগর এলাকায় অবকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রয়োজনে বেসরকারি খাতকে চুক্তিভিত্তিক যুক্ত করার সুপারিশ করা হবে।"
"ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো হবে প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। প্রতিটি ইউনিয়নে দুইজন এমবিবিএস চিকিৎসক, একজন মিডওয়াইফ, একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান, একজন সহকারী কর্মী ও একজন প্রহরী নিয়োজিত রাখার সুপারিশ করা হবে," যোগ করেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যসেবা চাহিদা যেমন—স্বাস্থ্য সচেতনতা, রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা, পুনর্বাসন, প্রশমনসেবা ইত্যাদি বিষয়গুলো পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত করা হয়। আর এই কৌশল এমনভাবে নিশ্চিত করে হয় যেন, রোগীর পছন্দ ও তার চাহিদার প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা বজায় থাকে।
গত মাসে কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৯১.১ শতাংশ মানুষ চান প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে যেন সংবিধানে বাধ্যতামূলক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যেন বাধ্যতামূলকভাবে সকল নাগরিকের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে, এমন সাংবিধানিক বিধান অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হবে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায়।
এছাড়া, প্রস্তাবনায় অপরিহার্য ওষুধের তালিকা সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের আদলে চিকিৎসকদের জন্য 'বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস কমিশন' গঠন এবং বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় বোর্ড গঠনের কথাও বলা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিকেন্দ্রীকরণ টারশিয়ারি হাসপাতালের ওপর চাপ কমাবে এবং একটি কার্যকর রেফারাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে।
কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. সায়েদ মো. আকরাম হোসেন বলেন, "প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় জেনারেল প্র্যাক্টিশনার (জিপি) পদ্ধতি চালু করা হবে। যেখানে রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী রেফার করা হবে। এমবিবিএস চিকিৎসকরাই জেনারেল প্র্যাক্টিশনার হিসেবে কাজ করবেন এবং তারা চাকরির পাশাপাশি তিন বছরের এই বিশেষ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে পারবেন।"
তিনি আরও বলেন, "স্থানীয় জিপি বা সাধারণ চিকিৎসকের রেফারেন্স ছাড়া কোনো রোগী বাড়তি চিকিৎসা নিতে পারবে না—এমন ব্যবস্থা চালুও করার সুপারিশ থাকবে। এছাড়া, শহরাঞ্চলে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের আদলে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা বলা হবে।"
সিভিল সার্জনের কার্যালয় শক্তিশালীকরণ
প্রস্তাবনায় প্রত্যেক জেলায় একজন অতিরিক্ত সিভিল সার্জন ও দুইজন ডেপুটি সিভিল সার্জন নিয়োগের সুপারিশ থাকবে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং সিভিল সার্জনকে প্রেসক্রিপশন মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
চিকিৎসকদের জন্য হেলথ সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ
বিচার বিভাগের আদলে চিকিৎসকদের জন্য একটি স্বাধীন 'হেলথ সার্ভিস কমিশন' গঠনের সুপারিশ করবে কমিশন, যা চিকিৎসকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে চিকিৎসকদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে কাজ করবে।
এই কমিশনের সচিব থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের দায়িত্বেই চিকিৎসক থাকবেন। এর মহাপরিচালক হবেন সচিব পদমর্যাদার।
ডা. জাকির হোসেন বলেন, "স্বাধীন কমিশনের অধীনে চিকিৎসকদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বর্তমান সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকবে এবং তা আরও বাড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে।"
তিনি আরও বলেন, "বর্তমান নিয়মের আওতায় দুর্গম অঞ্চলে কর্মরতদের জন্য বেতন বাড়ানোর সুযোগ নেই। এই বাধা দূর করা হবে এবং গবেষক ও শিক্ষকদের জন্যও বেতন বাড়ানোর সুযোগ থাকবে।"