আড়াই বছর পরেও কেন পুরোপুরি চালু হয়নি ১,৫০০ কোটি টাকার সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল

জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের বিদেশমুখীতা কমানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে যাত্রা শুরু করে বিএসএমএমইউ' এর ১,৫০০ কোটি টাকার সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। কিন্তু, উদ্বোধনের আড়াই বছর পার হলেও সে লক্ষ্য বা প্রতিশ্রুতি অপূর্ণই রয়েছে, কারণ নামমাত্র চিকিৎসক, নার্স, কর্মী দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এটি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মতে, ৭৫০ শয্যার হাসপাতালটি পরিচালিত হচ্ছে মাত্র ৩০০ কর্মী নিয়ে, অথচ জনবলের প্রয়োজন ২,৭০০ এর বেশি। এই স্থাপনার ১০০ বেডের আইসিইউ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। অন্যদিকে, ২৮৩ কোটি টাকার অব্যবহৃত উচ্চ মানের চিকিৎসা যন্ত্রের আনুষ্ঠানিক ওয়ারেন্টি শেষ হতে চলেছে এবছরের ডিসেম্বরে।
হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. শহিদুল হাসান টিবিএসকে বলেন, 'হাসপাতাল পুরোদমে চালু করতে জনবল সংকট আমাদের মূল সমস্যা। ৭৫০ বেডের হাসপাতালে জনবল লাগে ২,৭০০ জনের বেশি। কিন্তু, আমাদের এখানে নিয়োগকৃত ২১১ জন ও বিএসএমএমইউ থেকে আসা কয়েকজনসহ এখন ৩০০ এর মত জনবল আছে। আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ, হেপাটোবিলিয়ারি, লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট সব জায়গাতে জনবল সংকট। জনবল সংকটের কারণে চালু হয়নি আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ।'
মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সরেজমিন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, অত্যাধুনিক, ঝকঝকে-পরিচ্ছন্ন ভবন, ভিতরেই ফাস্ট ফুডের দোকান, ব্যাংকের শাখা, চালু আছে চলন্ত সিড়ি, সুপরিসর লিফট, কিন্তু নেই রোগীর আনাগোনা।
আউটডোরে ডাক্তার দেখানোর জন্য পুরো হাসপাতালের এক থেকে তিন তলা পর্যন্ত— দিনের বেলায় কিছু লোক সমাগম দেখা গেছে। নিচতলার আউটডোরে ১০-১৫ জন অপেক্ষারত রোগী দেখা গেছে। হাসপাতালের কেবিনে ১৫ জন আর ওয়ার্ডে মাত্র ২২ রোগী ভর্তি। সিসিইউ, এনআইসিইউ, আইসিইউ কিছুই চালু হয়নি।
ডা. শহিদুল হাসান জানান, কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। নিয়োগের মাধ্যমে জুনের মধ্যেই হাসপাতালটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করতে চাচ্ছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালটি পুরোপুরি চালু হলে — চিকিৎসার জন্য ভারত যাওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।

ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বছরে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি চিকিৎসা সেবা নিতে ভারতে যান। তারা অন্তত ৫০ কোটি ডলার দিয়ে আসছেন প্রতিবেশী দেশটির স্বাস্থ্যসেবা খাতকে।
তবে ভারতীয় ভিসা নিয়ে জটিলতার কারণে গত বছরের থেকে নভেম্বর থেকেই অনেক রোগীর ভোগান্তি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তাদের জন্য উপযুক্ত একটি বিকল্প হতে পারবে সর্বাধুনিক সুপার স্পেশালাইজড হসপিটাল।
বিএসএমএমইউ এর উত্তর দিকে ৩.৪ একর জমিতে হাসপাতালটি নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণ ব্যয়ের মোট ১ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ঋণ হিসেবে ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা দিয়েছে। হাসপাতালটি নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর দ. কোরিয়ার সঙ্গে ১৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ড-সহ ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৭৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে রয়েছে— ১৪টি সর্বাধুনিক অপারেটিং থিয়েটার, ১০০ শয্যার একটি নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ), ১০০ শয্য্যার একটি জরুরি বিভাগ, ছয়টি ভিভিআইপি কেবিন, ২২টি ভিআইপি কেবিন এবং ২৫টি ডিলাক্স কেবিন।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মডিউলার অপারেটিং থিয়েটার রয়েছে ১১টি এবং বিশ্বমানের পাঁচটি কেন্দ্র রয়েছে যেগুলো পাঁচ ধরনের চিকিৎসাসেবার জন্য বিশেষায়িত। এগুলো হলো— কার্ডিও অ্যান্ড কার্ডিওভাসকুল্যার সেন্টার, হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সেন্টার, মা ও শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, কিডনি ডিজিস সেন্টার এবং ইমার্জেন্সি সেন্টার।
জুনে হাসপাতাল পুরোপুরি চালুর উদ্যোগ
চলতি বছরের জুন থেকে প্রথম ধাপে ৩০০ বেড চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ডা. শহিদুল হাসান বলেন, 'প্রথম ধাপে ৩০০ বেড চালু করার জন্য ১ হাজার ৫৪৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এরমধ্যে সিনিয়র চিফ কনসালটেন্ট ৮ জন, চিফ কনসালটেন্ট ২২ জন, সিনিয়র কনসালটেন্ট ৩২ জন, কনসালটেন্ট ৫৭ জন, মেডিকেল অফিসার ২৩১ জন, ৫৯৮ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স, অন্যান্য স্টাফ ও আইটসোর্সিং থাকবে। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট মিটিংয়ের পর জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।'
তিনি আরো বলেন, 'আমাদের আউটডোর (বহির্বিভাগ সেবা) এখন চলছে— কিন্তু রোগী ভর্তি করা হচ্ছে কম। সক্ষমতার তুলনায় কম সার্ভিস পাচ্ছে রোগীরা। ৩০০ বেড চালু হলে এ সংকট কেটে যাবে।'
তবে নতুন নিয়োগের অর্থ কোথা থেকে আসবে— সেটি এখনো একটি বড় সমস্যা। মন্ত্রণালয় বেতনের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চিকিৎসায় বিদেশগামীতা কমাতে পাঁচ ধরনের রোগের ওপর গুরুত্ব
যেসব রোগে বাংলাদেশি রোগীরা বেশি বিদেশে যায়, সেসব রোগের চিকিৎসা সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে দেয়ার কথা গত বছরের ডিসেম্বরে জানিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা সায়েদুর রহমান।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, কিডনি, হার্ট ও লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট, ইনফার্টিলিটি, ক্যান্সারের চিকিৎসায় বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে এ হাসপাতালে।
দেশে এখনো সরকারি পর্যায়ে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন খুব কম হয়, দেশে লিভার-হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় না। এ হাসপাতালে এই চিকিৎসাগুলো শুরু হলে— রোগীদের আর বিদেশে যেতে হবে না, এতে তাদের খরচ ও ভোগান্তি কমবে।
বিএসএমএমইউ এর প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ বলেন, ৩০০ বেড চালু হলে ইনফার্টিলিটি, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট, লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট, কার্ডিয়াক ও ক্যান্সার রোগীদের ভর্তি করা শুরু হবে।
'যেসব রোগের চিকিৎসায় রোগীরা বেশি বিদেশ যায়— তারা বিশ্বমানের সেবা পাবে এখানে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে এসব রোগের যেসব বাংলাদেশি ডাক্তার আছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। অনেকে দেশে এসে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে সাড়া দিয়েছেন। জুলাই থেকে তারা সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে এসে চিকিৎসা দেয়া শুরু করবেন বলে আশা করা হচ্ছে'- তিনি যোগ করেন।
যন্ত্রপাতির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পথে
হাসপাতালের জন্য ৪০৩ রকমের ৬ হাজার ৬১২টি চিকিৎসাযন্ত্র কেনা হয় ২৮৩ কোটি টাকায়। এসব যন্ত্রপাতি ২০২২ সালের আগস্ট ও ডিসেম্বরে দুই ধাপে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামসাং। যন্ত্রগুলো সার্ভিস দেয়ার উপযোগী থাকলেও— জনবল না থাকায় অধিকাংশ যন্ত্রপাতি একদিনও ব্যবহার হয়নি। এসব যন্ত্রের অধিকাংশের ওয়ারেন্টির সর্বোচ্চ মেয়াদ রয়েছে তিন বছর। ফলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে অধিকাংশ যন্ত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে।
বিএসএমএমইউ'র প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ টিবিএসকে বলেন, এ বছরে যন্ত্রপাতির মেয়াদ শেষ হবে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা সার্বিক বিষয় জানাবে। কিছু মেশিনের দুই বছরের রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি আছে। সেসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। আগামী ২৬ তারিখ সিন্ডিকেট মিটিংয়ে কমিটি জানাবে কোন যন্ত্রের কতদিন মেয়াদ আছে, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সাবেক প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ড. জুলফিকুর রহমান বলেন, 'প্রায় ৬ হাজার যন্ত্র বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক যন্ত্রের ওয়ারেন্টি পিরিয়ড তিন বছর ছিল। প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই তৎকালীন কর্তৃপক্ষ জনবল নিয়োগ না দিয়েই হাসপাতাল চালু করে, যা ঠিক হয়নি। যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে— সেগুলো তো একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।'
'এখন দ্রুত গতিতে জনবল নিয়োগ দিয়ে স্টেপ বাই স্টেপ হাসপাতালটি চালু করতে হবে। এতো অত্যাধুনিক একটি হাসপাতাল এভাবে পড়ে থাকায়— মানুষ সেবা বঞ্চিত হচ্ছে। তবে এ হাসপাতাল পরিচালনার জন্য প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট প্রয়োজন'- যোগ করেন তিনি।
বিএসএমএমইউয়ের তৎকালীন প্রশাসনের অনিয়ম
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে যে ২৫০ জন জনবল নিয়োগ দেয়া হয়— তাতে তৎকালীন ভিসি শারফুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ দুদকে জমা দিয়েছিলেন হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এ ঘটনার পর পর ২০২৩ সালের জুনে তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক হাসপাতালটির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শারফুদ্দিন আহমেদকে না রাখার বিষয়ে জানান।
নিয়োগ ছাড়াও হাসপাতালের অভ্যন্তরে দুটি ব্যাংক ও একটি ফার্মেসি পরিচালনায় অনিয়ম হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২ ফেব্রুয়ারি দুদক অভিযান চালায় হাসপাতালটিতে।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল প্রকল্পের অর্থায়নে ১৫৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে –- প্রশিক্ষণ শেষে অত্র প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৫ বছর চাকরি করবেন এ ধরনের শর্তে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হলেও, প্রশিক্ষণ শেষে ৮৫ জন কর্মকর্তা হাসপাতালে যোগদান করেননি বলে জানিয়েছে দুদক। এছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে প্রেরণের অনিয়মের সত্যতাও পেয়েছে দুদক।