গ্রীষ্মের বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুত হচ্ছে সরকার, শহর-গ্রামে হবে সমান লোডশেডিং

গরম ধীরে ধীরে বাড়ছে, আর সূর্য তার গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহের জন্য প্রস্তুত। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় সরকার তার কর্মপরিকল্পনা সাজাতে শুরু করেছে, আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি ন্যায়সংগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুরোনো সেই কৌশল—যেখানে ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে গ্রামীণ অঞ্চলের ঘরবাড়ি অন্ধকারে রাখা হতো, এবার আর অনুসরণ করা হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, এবার গ্রীষ্মে শহরের ঝলমলে আলো আর এসির আরামের জন্য গ্রামের মানুষদের মুখ বুজে ঘামে ভেজার দিন শেষ।
এই নতুন সংকল্পের প্রতীকস্বরূপ, বিদ্যুৎ বিভাগ এবার স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদকদের (আইপিপি) হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও)–চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভর করছে। যাতে জাতীয় গ্রিডের চাপ সামাল দেওয়া যায়। উচ্ খরচ ও উচ্চ উৎপাদনক্ষম এই কেন্দ্রগুলো সাধারণত অচল থাকে। কিন্তু এখন আইপিপিগুলো জানিয়েছে, তারা প্রস্তুত; চাহিদা অনুযায়ী টারবাইন চালু করার অপেক্ষায় আছেন তারা।
এই চক্রে অর্থই ছিল সবচেয়ে দুর্বল অংশ। কিন্তু এবার সেটাও দ্রুত সরবরাহ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জরুরি জ্বালানি এলএনজি আমদানি নিশ্চিত করতে অর্থ বিভাগ ২,৪০০ কোটি টাকা ছাড় দিয়েছে। পাশাপাশি, সরকার আন্তর্জাতিক জ্বালানি সহযোগীদের বকেয়া পরিশোধ করে দিয়েছে। সম্পর্ক মেরামত ও সরবরাহ নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে শেভরন। গত বছর আগস্ট পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির পাওনা ছিল ৫৩২ মিলিয়ন ডলার। সেই পুরো টাকা এখন পরিশোধ করা হয়েছে। এটি সরকারের আর্থিক অঙ্গীকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, 'রমজানে আমরা তুলনামূলকভাবে ভালোই সামলাতে পেরেছি।' তিনি বলেন, 'বড় ধরনের লোডশেডিং হয়নি। কিন্তু গ্রীষ্মকাল একেবারে ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। আমরা খুব শিগগিরই দুবার বৈঠকে বসব ঈদুল আজহা ও বাকি গ্রীষ্মকাল নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করতে।'
পরিস্থিতি কঠিন হতে পারে। তাপমাত্রা যদি ৪২ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়—যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন আর অস্বাভাবিক নয়—তাহলে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে ১৭,০০০ থেকে ১৭,৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
উপদেষ্টা বলেন, 'বিদ্যুতের সরবরাহ তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক রাখতে হলে আমাদের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে, যদিও এগুলোর উৎপাদন খরচ বেশি। এটিই আমাদের আপস।'
তবে সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা দৃষ্টিভঙ্গিতে।
তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, 'এবার লোডশেডিং শহর ও গ্রামের মধ্যে সুষমভাবে ভাগ করা হবে। আমরা ঢাকাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি প্রত্যাখ্যান করেছি।'
বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) এর সভাপতি কেএম রেজাউল হাসনাত বলেন, বেড়ে চলা আর্থিক চাপের মধ্যে ব্যক্তিগত উৎপাদকদের ওপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে। তাদেরকে এই পরিস্থিতিতে আরও বেশি কাজ করতে বলা হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'আমরা একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি – বকেয়া পরিশোধ না হওয়া, সার্ভিস চার্জ কমানোর কারণে লাভের সীমা সংকুচিত হওয়া এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন।'
তবে চাপের মধ্যেও স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদকরা প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।
হাসনাত বলেন, 'আমাদের এইচএফ-চালিত কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা কেবল ৪,৫০০ মেগাওয়াট। সরকার সেগুলো কাজে লাগাতে চাইলে, সেগুলো প্রস্তুত আছে।'
তবে বিদ্যুৎ বিভাগ কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা এবং কৌশল সত্ত্বেও, গ্রাহকদের গ্রীষ্মকালে ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত হালকা থেকে মাঝারি লোডশেডিং সহ্য করতে হতে পারে। অন্যথায় লোডশেডিং ৩,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সিদ্ধান্ত বদলের কারণ
এইচএফ-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু না রাখার সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চাইলে পিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, 'বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালানোর মতো পর্যাপ্ত গ্যাস নেই। আবার পুরোনো ট্রান্সমিশন লাইনও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র চালাতে বাধা দিচ্ছে।'
তিনি জানান, 'আমরা যখন ৪০০ কেভি থেকে ১৩১ কেভিতে ভোল্টেজ কমিয়ে আনি, তখন কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও কড্ডার মতো এলাকায় পুরোনো লাইনের কারণে সিস্টেম লস হয়। এই সমস্যাগুলো ঠিক হলে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি চালানো যাবে।'
পিডিবির আশা, ট্রান্সমিশন লাইনের এই সমস্যা আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সমাধান হবে।
এইচএফভিত্তিক ও অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র: উৎপাদন ও সক্ষমতা
পিডিবি কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রতিদিন সন্ধ্যা ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চালু রাখা হচ্ছে। গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ঘাটতি পূরণে এগুলো প্রতিদিন ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
তেলচালিত কেন্দ্র থেকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩,৭০০ থেকে ৩,৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। গরম ও দাবদাহ আরও বাড়লে এই উৎপাদন আরও বাড়তে পারে।
পিডিবির ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট ১৪০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ২৭,০১৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৫৫টি এইচএফ-চালিত কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৫,৬৬৩ মেগাওয়াট এবং ৫টি ডিজেলচালিত কেন্দ্রের ৬২২ মেগাওয়াট।
অন্যদিকে, ৫৭টি গ্যাসচালিত কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১১,৬২৫ মেগাওয়াট, ৭টি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের ৫,৬০৩ মেগাওয়াট, ১টি জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ২৩০ মেগাওয়াট, ১৫টি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৭৬২ মেগাওয়াট এবং ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের পরিমাণ ২,৫০৮ মেগাওয়াট।
এর মধ্যে– এইচএফও (হেভি ফুয়েল অয়েল) চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৫টি, মোট উৎপাদনক্ষমতা ৫,৬৬৩ মেগাওয়াট; ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫টি, উৎপাদনক্ষমতা ৬২২ মেগাওয়াট; গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫৭টি, উৎপাদনক্ষমতা ১১,৬২৫ মেগাওয়াট; কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ৭টি, উৎপাদনক্ষমতা: ৫,৬০৩ মেগাওয়াট; জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ১টি, উৎপাদনক্ষমতা: ২৩০ মেগাওয়াট; সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র ১৫টি, উৎপাদনক্ষমতা: ৭৬২ মেগাওয়াট এবং ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ ২,৫০৮ মেগাওয়াট।
এইচএফও–ভিত্তিক বিদ্যুতে নির্ভরতার ঝুঁকি
এইচএফও–ভিত্তিক (তেলচালিত) বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশি নির্ভর করার একটি বড় ঝুঁকি হলো, এতে বিদ্যুৎ বিভাগের ভর্তুকি ১০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণ এসব কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা, যা গ্যাস বা কয়লাচালিত কেন্দ্রের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি।
অথচ বাংলাদেশ বর্তমানে ৪৭০ কোটি ডলারের আইএমএফ ঋণ কর্মসূচিতে রয়েছে, যা সাত কিস্তিতে দেওয়ার কথা। এর মধ্যে তিন কিস্তি ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। এই ঋণের শর্তগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
এই লক্ষ্য পূরণে সরকার ব্যয়বহুল তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাওয়ার নীতি গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে তেল আমদানিতে দেওয়া সেবামূল্য ৯.০৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এছাড়া, বেসরকারি পর্যায়ে যারা তেল আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করে, তাদের জন্য কার্গোর পরিমাণ ১৫,০০০ টন থেকে বাড়িয়ে ২০,০০০ টন নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা বলছেন, এটি তাদের জন্য যেন এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে।
পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে খরচ হয় ১২–১৩ টাকা, গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র ১৫ টাকা, আর তেলচালিত কেন্দ্রে খরচ হয় ৩৫–৪৫ টাকা।