বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে জয়ের পথে বিএনপি-জামায়াত

১৩২ বছরের ইতিহাসে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকায় ভোট ছাড়াই সবকটি—মোট ২১টি—পদে জয়ের পথে রয়েছেন বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীদের প্যানেল।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে, ২১টি পদের জন্য মোট ২১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সকলেই বিএনপি ও জামায়াত-ই-ইসলামী সমর্থিত 'ঐক্য পরিষদ' প্যানেলের সদস্য। আওয়ামী লীগপন্থি বা বামঘেঁষা কোনো আইনজীবী মনোনয়ন জমা দেননি। তাদের অভিযোগ, মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতেও তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে।
শনিবার বিকেলে নির্বাচন কমিশনার অ্যাডভোকেট মো. মাসুদুল আলম নিশ্চিত করেছেন যে, যাচাই-বাছাই শেষে জমা পড়া ২১টি মনোনয়নপত্রই বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো পদেই প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সব প্রার্থীই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আজ আমরা চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করব এবং আগামীকাল বিজয়ীদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে।"
এর ফলে আগামী ১৬ এপ্রিল হতে যাওয়া নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ঐক্য পরিষদ প্যানেল থেকে সভাপতি পদে অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার, সাধারণ সম্পাদক পদে মোহাম্মদ হাসান আলী চৌধুরী, সহসভাপতি পদে আলমগীর মোহাম্মদ ইউনুস, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে মো. ফজলুল বারী, কোষাধ্যক্ষ পদে মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, গ্রন্থাগার সম্পাদক পদে তৌহিদুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে আশরাফি বিনতে মোতালেব, ক্রীড়া সম্পাদক পদে এম. মনজুর হোসেন এবং তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে আবদুল জব্বার মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
এছাড়াও সদস্য পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন অ্যাডভোকেট আহসান উল্লাহ মানিক, আসমা খানম, বিবি ফাতেমা, হেল উদ্দিন, মেজবাহ্ উল আলম আমিন, মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী, মো. রুবাইয়াতুল করিম, মো. শাহেদ হোসেন, মোহাম্মদ মোরশেদ, রাহিলা গুলশান এবং সাজ্জাদ কামরুল হোসেন।
প্রতিবন্ধকতা ও হুমকির অভিযোগ
'রশিদ-জাবেদ-মাহতাব পরিষদ' ব্যানারে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা অভিযোগ করেন, বিএনপি-জামায়াতপন্থি প্যানেল পরিকল্পিতভাবে তাদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহে বাধা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের সম্ভাব্য সভাপতি পদপ্রার্থী মো. আবদুর রশিদ লোকমান অভিযোগ করে বলেন, ১০ এপ্রিল তারা তিনবার চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির গ্রন্থাগারে মনোনয়নপত্র সংগ্রহে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই বিএনপি-জামায়াতপন্থি প্রার্থীরা তাদের সেখানে ঢুকতেই দেয়নি।
তিনি বলেন, 'আমরা তিনবার চেষ্টা করেছি গ্রন্থাগারে ঢুকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে, কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা আমাদের কক্ষে ঢুকতেই বাধা দেয়। পরে, কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সেখান থেকে সরে আসি।'
আবদুর রশিদ লোকমান বলেন, ঘটনার পর তারা অ্যাড-হক কমিটির কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ জানালেও কোনো সমাধান হয়নি। তিনি বলেন, 'সমিতির ৯৮ শতাংশ সদস্য ভোট দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকজন ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করেছেন।'
তিনি আরও অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশন নিজেই সমিতির গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করেছে। তার ভাষায়, 'গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মনোনয়নপত্র সংগ্রহের জন্য ৭২ ঘণ্টার সময় নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু কমিশন মাত্র দুই ঘণ্টা সময় দিয়েছে, যা সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্র-বিরোধী।'
এছাড়াও, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)-সমর্থিত এবং বর্তমানে পাবলিক সেফটি ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী শাহাদাত হোসেনসহ অন্যান্য প্রার্থীরাও মনোনয়ন সংগ্রহে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
আওয়ামী লীগপন্থি প্যানেলের সম্ভাব্য সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ফখরুদ্দিন জাবেদ আরও অভিযোগ করেন, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে অনুমোদনহীন সভা-সমাবেশ ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, 'নির্বাচন কমিশন এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে নীরব থেকেছে।'
এদিকে, কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী বলেন, 'যখন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না, তখন নির্বাচিত নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।'
নির্বাচন কমিশন এবং বিজয়ী প্যানেলের প্রতিক্রিয়া
মনোনয়নপত্র সংগ্রহে বাধা দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার অ্যাডভোকেট মো. মাসুদুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা লাইব্রেরি কক্ষে বসে মনোনয়নপত্র বিতরণ করছিলাম। যদি কেউ কক্ষে পৌঁছাতেই না পারে, তাহলে আমাদের করার কী ছিল?'
তিনি আরও বলেন, 'বিরোধীপক্ষ আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিতে পারত। তারা অ্যাড-হক কমিটির সভাপতির কাছে একটি চিঠি দিয়েছে, কিন্তু সেটা আমাদের কাছে পৌঁছায় অনেক দেরিতে।'
তবে অ্যাডভোকেট মাসুদুল স্বীকার করেন, এ ঘটনাটি সমিতির ইতিহাসে লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে থাকবে। তিনি বলেন, 'আমরা সবসময় ঐক্যে বিশ্বাস করি। সমিতির গৌরবময় ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই গৌরবময় ইতিহাসে কলঙ্কের দাগ লেগেছে।'
বিএনপি-জামায়াতপন্থি প্যানেলের সভাপতি পদপ্রার্থী অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, 'আমরা আইনানুগভাবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছি। অন্যরা শুধুই নিজেদের অনুপস্থিতির অজুহাত দিচ্ছে।'
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ৫ হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত সদস্য থাকলেও ভোট গ্রহণ না হওয়ায় অনেক আইনজীবী হতাশা প্রকাশ করেছেন। এই হতাশা চট্টগ্রামের আইনজীবী মহলে ব্যাপকভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
এই নির্বাচন আসে কয়েক মাসের অস্থিরতার পর। পূর্ব নির্ধারিত নির্বাচনটি ১০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, ৪ ফেব্রুয়ারি কমিশনের পাঁচ সদস্য পদত্যাগ করলে তা স্থগিত হয়। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তারা হুমকি ও হয়রানির অভিযোগ করেছিলেন। পরবর্তীতে একটি অ্যাড-হক কমিটি গঠন করা হয় এবং ১৮ মার্চ নতুন করে নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করা হয়।
সংশোধিত সময়সূচি অনুযায়ী, ১০ এপ্রিল মনোনয়নপত্র সংগ্রহের শেষ দিন ছিল। ১১ এপ্রিল যাচাই-বাছাই, ১২ এপ্রিল প্রত্যাহার, এবং ১৬ এপ্রিল ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারিত ছিল—যা এখন কার্যত বাতিল হয়ে গেছে।