যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ ইস্যুতে টাস্কফোর্স গঠন করার পরামর্শ আইসিসিবির

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে নতুন করে বাড়তি শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে জাতীয়ভাবে করণীয় নির্ধারণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর কষাকষির বিষয়টি যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, আমদানি-রপ্তানিকারকদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি)।
সোমবার (৭ এপ্রিল) রাজধানীর বনানীর হোটেল টিউলিপ গার্ডেনে এক সংবাদ সম্মলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এ পরামর্শ দেওয়া হয়। গত বুধবার ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত পাল্টা শুল্কারোপের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে—তা নিয়ে আইসিসিবির পর্যালোচনা জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান, ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির সভাপতি এবং টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশেন (বিটিএমএ) সভাপতি আব্দুল হাই সরকার, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি কামরান টি রহমান, ফরেন চেম্বারের সভাপতি নাসের এজাজ বিজয়, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ, বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী সিমিন হোসেন প্রমুখ।
এ সময় বক্তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে নতুন করে বাড়তি শুল্কের বিষয়টি নিয়ে দেশের ব্যবসায়ী সমাজ বিব্রত এবং চিন্তিত। এ কারণে প্রাথমিকভাবে রপ্তানিতে এক ধরনের ধাক্কা আসতে পারে।
তবে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে সরকার সঠিক পথেই হাঁটছে। ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে চিঠি পাঠানোই যথেস্ট নয়।একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন বলে উল্লেখ করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলেনে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আইসিসিবির পক্ষ থেকে আরও বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এরমধ্যে রয়েছে, আমেরিকার থেকে আমদানি পণ্যের শুল্ক বাবদ যে ১,৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব সরকার পেয়ে থাকে, সেসব পণ্যে শুল্কহার কমানোর ঘোষণা দেওয়া; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কুটনৈতিক তৎপরতার বাড়ানো; বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-এর সদস্য হিসেবে ঢালাও শুল্ক ছাড় না দিয়ে এক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে শুল্কহার নির্ধারণ; শুল্কারোপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গে যৌথভাবে কোনো উদ্যোগে আসা ইত্যাদি।
আইসিসিবি সভাপতি বলেন, "১৯৩০ সালের পর থেকে এ ধরনের পাল্টা শুল্কারোপের নজির নেই। ট্রাম্প প্রশাসন ডব্লিউটিও'র আইন-বিধি লঙ্ঘন করে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। এটা তারা করতে পারে না।"
এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি করতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমেরিকা বিশ্ব অর্থনৈতিক মোড়ল হওয়ায় অনেক দেশ ট্যারিফ প্ল্যানের হাত থেকে বাঁচতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম আমেরিকান পণ্যে শূন্য শুল্কের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশকেও বর্ধিত এই শুল্কের প্রভাব মোকাবিলায় চিঠি চালাচালির পরিবর্তে দৃশ্যমান কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।"
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মার্কিন শুল্কের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে দ্রুত জরুরি বৈঠক ডাকার পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানান তিনি।
এ পরিস্থিতিতে খুব বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নেই উল্লেখ করে বলেন, "ধৈয্য ধরতে হবে। অন্য দেশ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারলে বাংলাদেশও পারবে।"
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিভিন্ন দেশের রপ্তানি তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অন্যান্য বড় রপ্তানিকারক দেশ যদি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের না পারার কোনো কারণ নেই।"
ফজলুল হক বলেন, "যেসব পণ্য রপ্তানির উদ্দেশে বন্দরে পড়ে আছে বা জাহাজে তোলা হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে বর্ধিত শুল্কহার কার্যকর হবে না। তবে দেশের কারখানাগুলোতে আগামী তিন থেকে চার মাসের জন্য যেসব রপ্তানি আদেশের কাজ চলছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ সময়ের রপ্তানিযোগ্য প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক উৎপাদনের কাজ চলছে। এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে অতিরিক্ত ৭৫ থেকে ৮০ কোটি ডলার শুল্ক গুনতে হবে। যদি ক্রেতাদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে বাড়তি শুল্ক ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়, তাহলে অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ কোটি ডলার দেশের রপ্তানিকারকদের পরিশোধ করতে হবে।"
উদাহরণ হিসেবে তিনি চীনের কথা বলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর শুল্ক আরোপের আগেই ট্রাম্প চীনা পণ্যে দুই দফায় ২০ শতাংশ হারে শুল্ক বসান। তখন থেকেই এই ভাগাভাগির পদ্ধতিতে শুল্ক বহন করছেন আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক উভয় পক্ষ।
এদিকে, আব্দুল হাই সরকার বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে বাংলাদেশে তুলা আমদানিতে শুল্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়ানো সম্ভব। তবে এতে ৪ থেকে ৫ সেন্ট দর বেশি পড়বে। অন্য দেশ থেকে আমদানি করলে সময়ও বেশি লাগবে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি করে পণ্য উৎপাদন করলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা কমে যেতে পারে।"
তবে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমিয়ে আনার মাধ্যমে এই বাড়তি ব্যয় সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।
ফরেন চেম্বারের সভাপতি বলেন, "পাল্টা শুল্কারোপ দুই ধাপে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। প্রথম ধাপে রপ্তানিকারকদের মুনাফা কমতে পারে, কারণ বিদেশি ক্রেতারা একা বর্ধিত শুল্কের ভার বহন করবেন না। দ্বিতীয়ত, শুল্কারোপের কারণে আমেরিকার বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যেতে পারে। এতে পোশাকের রপ্তানি ভলিউমও কমে যেতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার অনুকূল না মনে হলে অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এতে ইইউর বাজারে বাংলাদেশ আরও প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে।