ঈদের ছুটিতে ঢাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে

ঈদের ছুটিতে ফাঁকা রাজধানীতে বেড়েছে মশার উপদ্রব।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দায়িত্বরতরা ঈদের ছুটিতে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম না চালানোয় উপদ্রব বেড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
যদিও উভয় সিটি করপোরেশন থেকে ঈদের আগে ফগিং এবং লার্ভিসাইড কার্যক্রম পরিচালনাসহ মশা নিয়ন্ত্রণের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তবে কর্মী সংকটের কারণে এসব উদ্যোগের অর্ধেকেরও বেশি ছুটির দিনে স্থগিত রাখা হয় বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, এতে কিউলেক্স ও এডিস মশার সংখ্যাও বেড়েছে তীব্রভাবে।
ঢাকা উত্তরের হাতিরঝিল এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ঈদের ছুটি ঢাকাতেই কাটিয়েছি পরিবার নিয়ে, কিন্তু ঢাকা ফাঁকা হলেও গত কয়েকদিনে মশার উপদ্রব কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ঈদের গত এক সপ্তাহ ধরে আমাদের এলাকায় কোনো মশার কীটনাশক প্রয়োগ করতে দেখিনি। আমার ৬ মাসের বাচ্চাকে সারাক্ষণ মশারির ভেতরে রাখতে হয়েছে। তারপরেও মশার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছি না।"
তিনি আরও বলেন, "শুধু বাসাতেই নয়, রাস্তায় বের হলে সব জায়গায়ই মশার উপদ্রব। বাধ্য হয়ে বাসার জন্য মশা তাড়ানোর স্প্রে এবং গায়ে মাখার লোশন কিনতে হয়েছে। বাসা লেকের কাছাকাছি হওয়ায় সন্ধ্যা হলেই বাসার দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা চলে আসে।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, এই এলাকার এক মশকনিধন কর্মী টিবিএসকে বলেন, "ঈদের দিন আমরা সবাই ছুটি কাটিয়েছি। তবে ঈদের ছুটি চলমান থাকায় আমাদের অনেকেই ছুটিতে আছেন। আমরা যারা আছি, তারা কিছু কিছু জায়গায় লার্ভিসাইডিং এবং ফগিং করছি। সত্যি বলতে, রমজান এবং ঈদের ছুটিতে কাজ একটু কম হয়।"
এই এলাকায় ঢাকা উত্তরের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত এবং এই ওয়ার্ডের মশক সুপারভাইজারের দায়িত্বে আছেন রফিক মাস্টার। তিনিও কাজে ঢিলেমির বিষয়টি স্বীকার করে টিবিএসকে বলেন, "রমজানে শতভাগ কাজ করা সম্ভব হয়নি, কাজে কিছুটা ধীরগতি ছিল।"
"এছাড়া বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল ফগিং টাইম, কিন্তু রমজান থাকায় ইফতারের সময় অনেক এলাকাবাসী ফগিং করতে নিষেধ করতেন। ফলে পুরোপুরি কাজ করা সম্ভব হয়নি। আর ঈদের ছুটি কাটিয়ে অনেকেই এখনও কর্মস্থলে ফিরেনি, ফলে কিছু এলাকা বাদ পড়ে যাচ্ছে। আশা করি, শনিবার থেকে পুরোদমে কার্যক্রম চালানো সম্ভব হবে," বলেন তিনি।
কল্যাণপুর ২ নম্বর রোড এলাকায় থাকেন হাফিজা আলম। তিনি টিবিএসকে বলেন, "সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মশার উপদ্রব বাড়তে থাকে। গত ২০ দিন ধরে মশা বেড়েছে। আগে ফ্যান ছাড়লে মশা কামড়াতো না, এখন ফ্যান ছাড়লেও মশা কামড়ায়। আমি এখন চিন্তিত, আমার ২ বছরের ছেলেকে নিয়ে।"
উত্তরখান এলাকার মোহাম্মদ সাকিব বলেন, "সন্ধ্যা হলে এলাকায় মশা ঘিরে ধরে। মশারি টানিয়ে ঘুমালে দেখা যায়, মশারির চারপাশে মশার পাল এসে ঢুকতে চাচ্ছে। একটু ফাঁকা জায়গা পেলেই ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে মশা। সিটি করপোরেশনের এলাকায়ও এত মশা, এক আতঙ্কে আছি, কখন না আবার ডেঙ্গু জ্বর হয়।"
ঢাকা উত্তরের গুলশান-বনানী এলাকা ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মশক সুপারভাইজার মো. আহসান হাবিব টিবিএসকে বলেন, "আমাদের নিয়মিত কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু গুলশান-বনানী লেক থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় মশা ছড়াচ্ছে। আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম এই এলাকায় কিছুদিন বন্ধ ছিল বিটিআই-এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য। এখন আবার আগের মতো কার্যক্রম চলছে। আমরা লেকের পানিতেও কীটনাশক ব্যবহার করছি।"
ঢাকা উত্তর সিটির শুধু এই এলাকাগুলোই নয়, মিরপুর, পল্লবী, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, মহাখালী, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, মধুবাগ, উত্তরা, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা মশার অসহনীয় উপদ্রবের কথা জানিয়েছেন।
শুধু ঢাকা উত্তর সিটিরই নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডগুলোর মশার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
বংশালের বাসিন্দা কাজী দেওয়ান টিবিএসকে বলেন, "ফাঁকা ঢাকাকে মশার রাজত্ব মনে হচ্ছে। মশারি টানিয়েও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। ড্রেনগুলো বর্জ্যে ভরে গেছে, কিন্তু সিটি কর্পোরেশন তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।"
কর্তৃপক্ষ কাজে অংশিক বিরতির কথা স্বীকার করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডাঃ নিশাত পারভীন টিবিএসকে বলেন, "মশক নিধন কর্মীরা তিনদিন ছুটি কাটিয়েছেন, তবে বাকি ছুটিতে প্রায় ৫০ ভাগ কার্যক্রম চালানো হয়েছে।"
ঢাকা উত্তরের সিনিয়র ইনসেক্ট কন্ট্রোল অফিসার মো. আসিফ ইকবাল বলেন, "আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কিউলেক্স মশা লেক ও জলাশয়ে প্রজনন করছে। ইনসেকটিসাইড স্প্রে করলেও বর্জ্য জমার কারণে কার্যকারিতা সীমিত হচ্ছে। তবে আমরা আবার কাজ শুরু করেছি এবং কিছু এলাকায় বিটিআই পরীক্ষা করছি।"
ঢাকা উত্তরের গুলশান-বনানী এলাকা অন্তর্ভুক্ত ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মশক সুপারভাইজার মো. আহসান হাবিব, বিটিআই পরীক্ষার জন্য কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, "কার্যক্রম আবারও শুরু হয়েছে।"
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ড. জি. এম. সাইফুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "কিউলেক্স মশার ঘনত্ব প্রতি সপ্তাহে দ্বিগুণ হচ্ছে। ফগিং কার্যকরী হচ্ছে না, কারণ একই পুরানো ইনসেকটিসাইড ব্যবহার করা হচ্ছে। যদি কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ থাকতো, তাহলে মশার ঘনত্ব এত বৃদ্ধি পেতো না।"
তিনি আরও বলেন, "বর্ষাকালে এডিস মশার উপদ্রব বাড়বে। ডেঙ্গু ইতোমধ্যে ঢাকা ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, এবং দেশজুড়ে জরুরি পদক্ষেপ ছাড়া উপদ্রব আরও ভয়াবহ হতে পারে।"
সূত্রের তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবারে নতুন করে ১৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এপ্রিলের প্রথম তিন দিনে ১৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ বছরের প্রথম তিন মাসে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১,৮৯০ জন ডেঙ্গু রোগী। এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন।