আওয়ামী লীগবিহীন মাঠে জমে উঠেছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ঈদ রাজনীতি

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রথম রমজান ও ঈদে রাজধানী থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নানান কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গন সরব রেখেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত। এরইমধ্যে রমজানজুড়ে ইফতার মাহফিল, জনসংযোগ ও নানান রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এসব দল।
ঈদ এগিয়ে আসতেই জনতার উদ্দেশে শুভেচ্ছা জানানোর রাজনীতি শুরু হয়েছে। বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে ঈদ শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা। আর এক্ষেত্রে বিএনপি নেতারাই রয়েছেন এগিয়ে।
বিএনপির জোরালো দাবি, আগামী ডিসেম্বরেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। সেই হিসেব মাথায় রেখে দলটি এখন পুরোদমে মাঠ গোছাচ্ছে। বিভিন্ন ইউনিটে নতুন কমিটি গঠন, ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি তৈরি এবং সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে সংগঠনগত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। পাশাপাশি নির্বাচন ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠানের দাবিতে জনমত গঠনের কাজও করছে দলটি।
এ উপলক্ষে সারা রমজানজুড়ে দলের নেতারা ও সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীরা আয়োজন করছেন ইফতার মাহফিল, জনসংযোগ ও ঈদ উপহার বিতরণ কর্মসূচি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নির্বাচনের প্রস্তুতি আমাদের সবসময়ই থাকে। আগামীতে যে নির্বাচন হবে, সেজন্যও আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরেই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। ঈদ সামনে রেখে স্থানীয় পর্যায়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনসম্পৃক্ততা বাড়াবেন, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, ঈদের সময়ে সবাই পরিবার-পরিজনের সঙ্গে থাকেন, ফলে মানুষের নাগাল পাওয়া সহজ হয়।"
এদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চায় বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। তবে বাস্তবে রমজান মাসজুড়ে এ দুই দলের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় পুরোদমে ইফতার মাহফিল ও জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। ঈদকে ঘিরেও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর কাজ অব্যাহত রেখেছেন তারা। যদিও তারা সংস্কারের পর নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন, কিন্তু তাদের কার্যক্রমে নির্বাচনমুখী প্রস্তুতির স্পষ্ট আভাস মিলছে।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের প্রস্তুতি জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, "আমরা সবসময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেই রাজনীতি করি। সংগঠন গঠন বা নির্বাচনের প্রস্তুতিও সে প্রক্রিয়ারই অংশ।"
তিনি জানান, সামনে নির্বাচন রয়েছে ধরে নিয়েই তারা সাংগঠনিক ও নির্বাচনী প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, "এখনও আমাদের আত্মপ্রকাশের দুই মাস হয়নি। তারপরও রমজানজুড়ে ইফতার মাহফিলের মাধ্যমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছি।"
তিনি জানান, ঈদের পর থেকে তারা সাংগঠনিক কার্যক্রম আরও জোরদার করবেন এবং এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবেন।
তিনি আরও জানান, দলীয় কেন্দ্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঈদ উপলক্ষে জনসংযোগ বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির ওয়ার্ড পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় সব নেতাই আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ কেউ রয়েছেন কারাগারে। একের পর এক মামলায় পর্যুদস্ত নেতাকর্মীরা এখন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা তো ভাবতেই পারছেন না, বরং জীবন রক্ষাই তাদের প্রধান উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঈদ উপলক্ষেও দলটির কোনো পর্যায়ে কোনো প্রস্তুতি বা সাড়া চোখে পড়েনি।
বিএনপিসহ তাদের সঙ্গে থাকা সমমনা দল ও জোট যে কোনো মূল্যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। তারা দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে। ইসলামী ঘরানার অন্যান্য দলও সংসদ নির্বাচন নিয়ে অহেতুক সময়ক্ষেপণের বিপক্ষে মত দিয়েছে।
এছাড়া, জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের সামনের কাতারে থাকা তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে 'জুলাই সনদ' বাস্তবায়নের কথা বলছে। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিচার, সংস্কার ও পরিবর্তনের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়েই তারা নির্বাচনমুখী হতে চায়। ইতোমধ্যে তারা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এনসিপি চায়, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একযোগে গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
দেশজুড়ে ঈদ রাজনীতি
ঈদ ছুটিতে সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন। ঈদের আনন্দঘন সময়কে কাজে লাগিয়ে বেশিরভাগ প্রার্থী জনগণের কাছাকাছি যাচ্ছেন এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন।
আওয়ামী লীগবিহীন রাজনৈতিক মাঠে অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচন-কেন্দ্রিক কার্যক্রমে এলাকামুখী হওয়ায়, ঈদকে ঘিরে সারাদেশে রাজনীতি চাঙা হয়ে উঠেছে।
রাজশাহীতেও রমজানজুড়ে ইফতার আয়োজনের মাধ্যমে গণসংযোগ বাড়ানো ও দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় করতে মাঠে ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
ইফতার আয়োজনের ধরনে পার্থক্য থাকলেও, দুটি দলই মূলত নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখা এবং আগামী দিনের রাজনৈতিক কর্মপন্থা বোঝাতে এই আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশা জানান, সময় স্বল্পতার কারণে এবার মহানগর বিএনপির কেন্দ্রীয়ভাবে ইফতার আয়োজন সম্ভব হয়নি। তবে সাংগঠনিক থানা পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
বিএনপির তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত বগুড়ায় রমজানজুড়ে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়েও দলটির ব্যাপক ইফতার আয়োজন ও জনসংযোগ কর্মসূচি চলেছে। জামায়াতে ইসলামী ও সদ্য আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)–ও দলীয়ভাবে ইফতার মাহফিল করেছে এবং ঈদ উপলক্ষে সক্রিয়ভাবে জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি মীর শাহে আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের দমন–নিপীড়ন, মামলা ও হামলার কারণে আমরা কোণঠাসা অবস্থায় ছিলাম। এখন কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা সংগঠনকে সক্রিয় করতে মাঠে কাজ করছি।"
এদিকে, সিলেটে পুরো রমজানজুড়ে ইফতারকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠ ছিল সরগরম। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ–সহযোগী সংগঠন সারা মাসজুড়েই ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছে।
আর এখন ঈদ এগিয়ে আসার সাথে সাথে শুরু হয়েছে ঈদ শুভেচ্ছা জানানোর রাজনীতি। নগরজুড়ে বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে বিভিন্ন নেতার পক্ষ থেকে জনগণকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে। এতে অবশ্য এগিয়ে রয়েছেন বিএনপি নেতারা।
(প্রতিবেদনটি প্রস্তুতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন দ্য বিজিনেস স্ট্যান্ডার্ড'র চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট ও খুলনা প্রতিনিধি)